সেই ১৯৫৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের যখন জন্ম হইয়াছিল, তখন সদ্যই ভারতকে মাঝখানে রাখিয়া, প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের দুই অংশ লইয়া পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে। ইত্তেফাকের জন্মের সময় বছর ছয়েক বয়সের পাকিস্তানের কোনো সংবিধানই প্রণীত হয় নাই। অথচ ১৯৪৭ সালে দেশ সৃষ্টির পর হইতেই দেখা দিয়াছিল অন্যায়, শোষণ, বঞ্চণা। এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধেই জন্ম লইয়াছিল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। আর সেই শোষণ-বঞ্চনা হইতে মুক্ত হইতে আওয়ামী লীগের কাঁধে কাঁধ রাখিয়া দৈনিক ইত্তেফাক মুখপত্র হিসাবে প্রতিবাদ জানাইয়া আসিয়াছে।
দেশ স্বাধীন হইয়াছে, দৈনিক ইত্তেফাকও পেশাদারিত্ব বজায় রাখিয়া স্বকীয় দায়িত্ব পালন করিতে চেষ্টা করিয়াছে; কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের পুরানা প্রবাদ মনে জাগিতেছে, ‘সেই রামও নাই, অযোধ্যাও নাই’। এই প্রতীকী প্রবাদে রাম বলিতে মানুষ এবং অযোধ্যা বলিতে স্থান ও কালকে বুঝানো হইয়া থাকে। ফলে মানুষ যখন দেখিতে পায় যে বর্তমানের চাইতে তাহার অতীত ভালো ছিল, সঙ্গে সঙ্গে সে এই প্রবাদের আশ্রয় লইয়া থাকে। দেশ স্বাধীন হইয়াছে, আমরা অনেক দিকে, বিশেষ করিয়া অবকাঠামো উন্নয়নে আগাইয়াছি; কিন্তু কতটা অর্জিত হইল বাকস্বাধীনতা, কতটা স্বাধীন হইয়াছে সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র তাহা প্রশ্নবিদ্ধই থাকিয়া গিয়াছে।
দেশে শিল্প হইতেছে কথা সত্য; কিন্তু সেই শিল্পের সহিত জড়িতরা নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির জন্য হা-হুতাশ করিতেছে। অবকাঠামোর উন্নয়ন হইতেছে সত্য; কিন্তু ঋণের অর্থে সেই উন্নয়ন হইবার কারণে একটি ভালনারেবিলিটি তো থাকিয়াই গিয়াছে। ইহার কারণেও অনেকে ‘ঋণ করিয়া ঘি খাই’ প্রবাদটিও স্মরণ করিয়া থাকেন। দেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় নানা বিশৃঙ্খলা দৃশ্যমান। কোনো কোনো খাতকে প্রাধান্য দিয়া কোনো কোনো খাতকে প্রায় অস্বীকার করা হইতেছে, যাহা অর্থনীতির জন্য একটি বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। দেশের অর্থনীতির চরিত্র অনুযায়ী ঔষধ, খাদ্য ও কাপড় উৎপাদনের খাতগুলি ভালনারেবল হইবার কথা নহে। অথচ এই উৎপাদন মার খাইতেছে। অথচ এই খাত নিম্নমুখী হইবার কোনো কারণ নাই। আবার এইরকম পরিস্থিতিতেও কোনো কোনো খাতের হাতে গোনা দুই-একটি প্রতিষ্ঠান আকাশ ছুঁইয়া ফেলিতেছে। ইহা আরও অধিক হতাশ করিতেছে সেই সকল ব্যক্তিকে, যাহারা স্বাধীন বাংলাদেশের সুফল ভোগ করিবার প্রত্যাশা করিতেন। এই ধরনের অবস্থার কথা বিবেচনায় রাখিয়াই দার্শনিক কনফুসিয়াস বলিয়াছিলেন, ‘একটি ভালো সরকারের জন্য দরিদ্রতা লজ্জাকর বিষয়, আর একটি অদক্ষ সরকারের জন্য সম্পদই লজ্জাকর হইয়া দেখা দিতে পারে।’ যেইখানে অসাম্য, অন্যায়, বৈষম্য সেইখানেই প্রতিবাদ করিবার এবং প্রতিবাদ করিবার অধিকার প্রদানের নামই গণতন্ত্র। উন্নয়নশীল দেশগুলির অনেক দেশেই ইহা অনুপস্থিত। আবার মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশের প্রতিবাদকারীরাই প্রতিবাদের ভাষা বুঝে না, প্রতিবাদের ধরন বুঝে না; কোনটা প্রতিবাদ আর কোনটা ফৌজদারি অপরাধ, সেই সম্পর্কে সচেতন নহে।
তবে এই সকল প্রতিকূলতা কাটিয়া যাইবে বলিয়া আমরা বিশ্বাস রাখি। একসময় যাহা মানুষ কল্পনা করে নাই, আজ তাহা বাস্তবে রূপ লইয়াছে। আবার আজ যাহা চিন্তায় আসে না, আগামীকাল তাহাই বাস্তব হইয়া সম্মুখে আসিবে। তাই ধৈর্য ধরিয়া আমাদের সকলকে সামনে আগাইতে হইবে।