প্রায় ৫০ বছর ধরে একটু একটু করে ইউরোপে সুবিশাল ‘এনার্জি মার্কেট (জ্বালানি বাজার)’ গড়ে তুলেছিল রাশিয়া। কিন্তু ৫০ সপ্তাহের কম সময়ের ব্যবধানে তা ধসিয়ে দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন! ইউরোপে রাশিয়ার এনার্জি মার্কেট এখন ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে। ইউরোপের মতো বৃহৎ জ্বালানি বাজার বিশ্বের অন্য যে কোনো প্রান্তে গড়ে তোলা রাশিয়ার জন্য শুধু কঠিনই নয়, অনেকটা অসাধ্য—এই দাবি বাড়াবাড়ি নয় মোটেই। রাশিয়া হয়তো নিজেও জানে এই সত্য। এ কারণে হন্যে হয়ে অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড অয়েল) বিকল্প বাজার খুঁজছেন পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তেল বিক্রি নিয়ে হিমশিম খাওয়া রাশিয়া ক্রেতা হিসেবে পায় ভারতকে। এই ধারাবহিকতায় রাশিয়ান তেলের বড় ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয় ভারত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইউরোপে তেল বিক্রি করে রাশিয়া যে পরিমাণ অর্থ পেত, এখন তা কমে গেছে বিপুল পরিমাণে। এর ফলে অর্থনৈতিকভাবে দেশটি যে চরম বিপর্যয়ে পড়েছে—এ কথা মানতেই হবে। এমন একটি কঠিন অবস্থায় রাশিয়ার জন্য ধেয়ে আসছে নতুন দুঃসংবাদ। বলা হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে বিশ্ব। সত্যিই যদি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ বা সীমিত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে, তথা জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প উত্সসমূহকে সাশ্রয়ী ও টেকসই করা যায়, তবে রাশিয়ার বিপদ বেড়ে যাবে বহুগুণ। যদিও এর জন্য বেশ লম্বা সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সবার মনে থাকার কথা, ২৪ ফেব্রুয়ারি মস্কোর সেনারা যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে বসে, তখন রীতিমতো হইচই পড়ে যায় গোটা ইউরোপে। বিশেষ করে চরম শঙ্কায় পড়ে যায় রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল ইউরোপীয় দেশগুলো। প্রথম দিকে ইউরোপের দেশে দেশে রাশিয়ান জ্বালানি সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও ক্রমশ তা সীমিত এবং মার্কিন তথা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও মূল্য বেঁধে দেওয়ার (প্রাইস ক্যাপ) মুখে পড়ে একসময় আশাতীতভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। ইউরোপে রাশিয়ান এনার্জি বাজার গুঁড়িয়ে যায় রাতারাতি। ঘটনা থেমে থাকে না শুধু তেলেই। রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার বাতাসে মিলিয়ে যায় চোখের পলকে!
মূলত পুতিনের সেনারা ইউক্রেনে ঢোকার পরপরই রাশিয়া থেকে ইউরোপের বেশ কিছু অংশে অপরিশোধিত তেলের চাহিদা কমতে শুরু করে। রাশিয়ার তেলের বাজারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয় গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুর দিকে। সমুদ্রপথে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের আমদানির ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের মধ্য দিয়ে প্রায় ক্রেতাশূন্য হয়ে যায় রাশিয়ান তেলের রমরমা বাজার। দু-একটি দেশের সঙ্গে অস্থায়ীভাবে টুকটাক বিক্রিবাট্টা করে রাশিয়া কিছু অর্থ পায় বটে, কিন্তু তা পড়ে থাকে দেশটির তেল বিক্রি তহবিলের একেবারে তলানিতে।
শুধু তেল নয়, গ্যাস বিক্রি নিয়েও একই ধরনের বিপদে পড়ে রাশিয়া। ইউরোপে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারও হারিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী শত শত বিলিয়ন ডলারের গ্যাসের বাজার গড়ে তোলে রাশিয়া। সুবিশাল গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয় দীর্ঘ পাইপলাইন নেটওয়ার্ক। এই গ্যাস পাইপলাইন সাম্রাজ্য এখন প্রায় অকেজো-পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা ইউরোপীয় গ্যাসের বাজারের বেশির ভাগই হারিয়েছে গ্যাসসমৃদ্ধ রাশিয়া। গ্যাস বাণিজ্যে রাশিয়ার দুর্ভোগের চিত্র এখানেই শেষ নয়, বরং সামনে ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা আরো ভারী হবে। ২০১৭ সালের দিকে ইয়ামাল উপদ্বীপে গ্যাসের মজুত উন্নয়ন প্রকল্পে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে দেশটি। মনে হয়েছিল, গ্যাস বিক্রির বিপুল অর্থের কাছে এই পরিমাণ অর্থ কিছুই নয়। কিন্তু এখন রাশিয়ার ‘মাথায় হাত’ অবস্থা! এই উপদ্বীপ থেকে বেশির ভাগ পাইপলাইন গেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে রাশিয়াকে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্ত করা এই পাইপলাইনের এখন কানাকড়ি দাম নেই! গ্যাস বিক্রি থেকে রাশিয়ার আয় এতটাই বেশি ছিল যে, ২০২৫ সাল নাগাদ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল দেশটির। সেই পরিকল্পনায় এখন গুড়ে বালি! কেননা, আগের ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বেশির ভাগই এখন পানিতে!
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধ তো একসময় না একসময় শেষ হবেই। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউরোপের সঙ্গে একধরনের জ্বালানি সম্পর্ক রক্ষা করতে চেষ্টা করবে রাশিয়া। হয়তোবা কিছুটা সক্ষমও হবে। কিন্তু একটি অনিবার্য বিষয়কে কোনোভাবেই এড়াতে পারবে না দেশটি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো আগের মতো রাশিয়ান তেল-গ্যাসের পানে চেয়ে থাকবে না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা রাশিয়ান জ্বালানিনির্ভরতা থেকে অবধারিতভাবে সরে আসতে চাইবে দেশগুলো, যা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান।
ইউরোপের সরকারগুলো, এমনকি ভোক্তারা জ্বালানির প্রশ্নে এখন অনেকটাই সংযমী হতে চেষ্টা করছে। জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়কে ভাবছে গুরুতরভাবে। তেল-গ্যাস থেকে মুখ ফিরিয়ে ঝুঁকছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে। নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগকে উত্সাহিত করছে প্রতিটি দেশ। এই অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপকভাবে। সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট, রাশিয়ান জ্বালানির কাছে নতুন করে নিজেকে বন্দি করতে নারাজ ইউরোপ।
এই যখন অবস্থা, তখন বসে নেই রাশিয়াও। রাশিয়ান তেল কোম্পানিগুলো বহুকালের পুরাতন ইউরোপীয় ক্রেতাদের থেকে ক্রমান্বয়ে সরে এসে নতুন নতুন ক্রেতার সন্ধানে মরিয়া—যেমনটা বলা হয়েছে আগেই। কিন্তু রাশিয়ান জ্বালানির প্রতি ইউরোপের বিমুখতা তো দেশটির জ্বালানি বাজারের জন্য বিরাট ধাক্কা! এই ধকল কাটিয়ে উঠতে বড় বড় ডিসকাউন্ট দেওয়ার মতো পথে পর্যন্ত নামে দেশটি, যা ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা! ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য কমানোর পথ ধরে তেল কোম্পানিগুলো। কম মূল্যের এই তেল লুফে নেয় অনেক রাষ্ট্রই—প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে। গত বছরের শেষ নাগাদ যে পরিমাণ রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল বিক্রি হয়, তার এক-চতুর্থাংশের ক্রেতা ছিল ভারত। পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী জোগানদাতা সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত থেকে সরে এসে রাশিয়া থেকে একচেটিয়া হারে তেল কেনে কয়েকটি দেশ। মজার ব্যাপার হলো, কিছু দেশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জ্বালানি বেশি পরিমাণে ইউরোপে রপ্তানি করছে এই উদ্দেশ্যে যে, সস্তায় রাশিয়ান ডিজেল কিনে তারা সেই শূন্যস্থান তথা নিজেদের চাহিদা মেটাতে পারছে।
মনে রাখার বিষয়, গত ৫৫ বছরের বেশির ভাগ সময় ধরে ক্রেতা হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে ছিল রাশিয়া। এজন্য হাজার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন রাশিয়ান গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে বের করে সংযুক্ত করা হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু সব ওলটপালট করে দিয়েছে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ। এমতাবস্থায় গ্যাস বিক্রির জন্য নতুন বাজার খুঁজতে পূর্বদিকে তাকাতে শুরু করেছে দেশটি। ভারতের মতো রাশিয়ান তেলের প্রথম সারির ক্রেতার তালিকায় আছে চীনের নামও। তবে আগামী দিনগুলোতে বেইজিং রাশিয়ান জ্বালানি নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই দেখার বিষয়। ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য একই কথা। এর পেছনের কারণও যুক্তিযুক্ত। কতিপয় ইউরোপীয় দেশ জ্বালানির প্রশ্নে মস্কোর ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে কী খেসারত দিচ্ছে, তা নিশ্চয় ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোর চোখ এড়াচ্ছে না।
একটা বিষয় ইতিমধ্যে পরিষ্কার, ইউক্রেনের মাটিতে বোমা ফেলে পুতিন যে ভুল করেছেন, তার চড়া মাশুল দিচ্ছে রাশিয়ার জ্বালানি খাত। যুদ্ধের ফলাফল শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক না কেন, মস্কো ও ইউরোপ আর কখনোই এক রাস্তায় চলবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। সত্যিকার অর্থে, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার বুকে যে ক্ষত সৃষ্টি করে দিয়েছে, তা শুকাতে লেগে যাবে যুগের পর যুগ। রাশিয়ার পরবর্তী প্রজন্মকেও চোকাতে হবে ইউক্রেন যুদ্ধের ভুলের মাশুল—এই বাস্তবতাকে পাশ কাটনো বেশ মুশকিল!
লেখক :জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সেন্টার ফর গ্লোবাল এনার্জি স্টাডিজের সাবেক সিনিয়র এনালিস্ট
ব্লুমবার্গ থেকে ভাষান্তর : সুমৃৎ খান সুজন