পুলিশ কর্তৃক লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতের পর মরদেহ নেওয়া হয় মর্গে। সেখানে লাশের ময়নাতদন্ত করেন চিকিৎসকরা। ময়নাতদন্ত শেষে সরকার নির্ধারিত ফর্মে রিপোর্ট লেখা হয়ে থাকে। অনেক চিকিৎসক এই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট লিখে থাকেন অস্পষ্টাক্ষরে। ফলে অস্পষ্ট হাতে লেখা এই রিপোর্টের কারণে প্রকৃত তথ্য উদ্ধারে বেগ পেতে হয় বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল ময়নাতদন্ত রিপোর্ট লিখতে হবে স্পষ্টাক্ষরে। হাতে লেখা ময়নাতদন্ত রিপোর্টের সঙ্গে একটি টাইপ কপিও দিতে চিকিৎসকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রায়ের এই নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এখনো টাইপ কপি ছাড়াই অনেক চিকিৎসক লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন শুধু হাতে লিখে পাঠাচ্ছেন।
এরকমই একটি ঘটনায় সম্প্রতি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের এক প্রভাষককে তলব করে হাইকোর্ট। তলব আদেশে ডা. জামান নিশাদ রায়হান নামের ঐ চিকিৎসক আদালতে হাজির হয়ে বলেছেন, জনবল ও অবকাঠামোর অভাবে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ আগামী ২৩ জানুয়ারি এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য রেখেছে। এ ধরনের সমস্যা কীভাবে নিরসন সম্ভব—সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঐ চিকিৎসককে লিখিত বক্তব্য দাখিল করতে বলেছে আদালত।
চিকিৎসকরা বলছেন, হত্যা, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনার মতো যে কোনো অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত করা হয়ে থাকে। এ ধরনের ঘটনায় শুরুতেই পুলিশ লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। অর্থাৎ মরদেহ কি অবস্থায় পাওয়া গেছে—তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এরপর মৃত্যু সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য ময়নাতদন্ত করে থাকেন চিকিৎসকরা।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যাসহ অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মামলার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। কিন্তু হাতে লেখা অস্পষ্ট ময়নাতদন্ত রিপোর্টের কারণে বিচার প্রক্রিয়া অহেতুক বিলম্বিত হয়। প্রায়শই অসুবিধায় পড়েন বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তাই এ ধরনের সমস্যা নিরসনে স্পষ্টাক্ষরে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট লেখার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এটা করা সম্ভব হলে মামলার তদন্তে গতি আসবে।
২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন স্পষ্টাক্ষরে লিখতে চিকিৎসকদেরকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ঐ রিপোর্টের একটি টাইপ কপি হাতে লেখা কপির সঙ্গে সংযুক্ত করতে বলা হয়। স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং সব সিভিল সার্জনকে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
কক্সবাজারের খুরুশখুল উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলায় জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. সোলতান আহমেদের লেখা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অস্পষ্ট হাতে লেখায় হাইকোর্ট এই নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সেই রায়ের নির্দেশনা সাড়ে তিন বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ইত্তেফাককে বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি। যাতে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি মেনে চলেন।
এদিকে গত বছরের ২১ মার্চ রাতে রাজশাহীতে রিয়াজ হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডের পর দিন নিহতের পিতা মো. মধু শেখ বোয়ালিয়া থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারভুক্ত অন্যতম আসামি নাইম ওরফে মো. আব্দুর রহিমের জামিন আবেদনের শুনানিকালে নিহতের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট অস্পষ্ট হাতে লেখার বিষয়টি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিদের নজরে আসে। এরপরই ঐ চিকিৎসককে তলব করে আদালত।
হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী ইত্তেফাককে বলেন, হাইকোর্টের রায়টি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট হাতে লেখা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট অনেক সময় ভুলভাবে উপস্থাপনের ফলে আসামি পক্ষ অহেতুক সুবিধা পেয়ে থাকে। অনেক রিপোর্ট পাঠযোগ্য না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষকেও আদালতে বিব্রত হতে হয় এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তি দুর্লভ হয়ে পড়ে।