আর্থিক সংস্কার খুবই প্রয়োজন


বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘চেঞ্জ অব ফেব্রিকস’। এই প্রতিবেদনে একটি ডায়াগনসিস করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে কী করতে হবে? বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ যদি আর্থিক খাত, বহির্বাণিজ্য খাত ও নগর পরিকল্পনায় সংস্কার সাধন না করে, তাহলে আগামী দুই দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। বিশ্বব্যাংক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই এই মন্তব্য করেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, সংস্কার কোন জায়গায় করতে হবে? সংস্কার অনেক ক্ষেত্রেই করতে হবে। তবে বিশ্বব্যাংক তিনটি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ। অনেক দিন ধরেই রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ও লক্ষণীয় অগ্রগতি সাধিত হয়নি। আর্থিক খাতে যেসব দুর্বলতা আছে, তা নিরসন করতে হবে। অর্থাৎ আর্থিক খাতে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধন করা। রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা এবং নগর-ব্যবস্থাপনাকে হালনাগাদ করা।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে ট্রেড পলিসি আছে তাতে দেশীয় বাজারে বিক্রি করাটা বেশি লাভজনক। তৈরি পোশাক খাত অবশ্য এর ব্যতিক্রম। কারণ তারা রপ্তানিক্ষেত্রে বিশেষ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরের উৎপাদকগণ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য নিয়ে যেতে চান না। আর তৈরি পোশাকশিল্পের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এই শিল্পে যে রপ্তানি আয় হয়, তার অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন  হয়। বাকিটা দেশের বাইরে চলে যায়। কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বাবদ আবারও দেশের বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ এই খাতটি স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর নয়। পণ্যের ওপর আরোপিত ট্যারিফ বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সংস্কারের কথা বলেছে। শুল্ককাঠামো সংস্কার করতে হবে। অবশ্য শুধু ট্যারিফ রিফর্ম করলেই হবে না। কারণ নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার প্রচুর আছে, সেগুলোও সংস্কারের মাধ্যমে দূর করতে হবে। বাণিজ্যের যে অবকাঠামো, সেখানেও সমস্যা আছে। সময় অনেক লাগে। খরচ হয় প্রচুর। নানা ধরনের জটিলতা আছে। এগুলোকে আরও সরলীকরণ করার প্রয়োজন রয়েছে।

আর্থিক সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন। কারণ আর্থিক খাত নানা দুর্বলতায় জর্জরিত হয়ে আছে। আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় দুটি দুর্বলতা হচ্ছে, নন-পারফরমিং লোনের (এনপিএল) ব্যাপক উপস্থিতি। আর একটি হচ্ছে আরপিএল। বাংলাদেশ ব্যাংক এনপিএলর যে পরিসংখ্যান প্রদর্শন করছে প্রকৃত পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি। করোনাকালীন অবস্থায় ঋণখেলাপিদের যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা উঠে গেলে এনপিএলর প্রকৃত পরিমাণ বোঝা যাবে। আরপিএল হচ্ছে এক ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরস্পর যোগসাজশে একজন আর একজনকে ঋণ দেয়। পরিচিত জনকে উপযুক্ততা না থাকা সত্ত্বেও ঋণ প্রদান করে। এই কী পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে। বিশ্বব্যাংক এটাকেও একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এজন্য করপোরেট গভর্ন্যান্স এবং ব্যাংকিং আইনের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এভাবে আইনি সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কালচার যদি কমানো যায়, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে যেসব ব্যাংক আইন মেনে সঠিকভাবে ব্যবসায় করতে চায়, তাদের জন্য সুবিধা হবে। তাদের ঋণদানের সক্ষমতা বাড়বে। ব্যাংকিং সেক্টরে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইনি পরিবর্তন করা হয়েছে, তার ফল কী হতে পারে, তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কারণ ব্যাংকিং ঋণগ্রহীতাদের করোনার সময় নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে। কাজেই এ সংক্রান্ত তথ্য আমাদের হাতে নেই। ব্যাংকিং সেক্টরের সঠিক পরিসংখ্যান পেলে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা সম্ভব হবে। তখন অনুধাবন করা যাবে ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের অবস্থা কেমন এবং সার্বিক অবস্থাই-বা কেমন। আইনি সংস্কারের মাধ্যমে ঋণ আদায় ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার একটি আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। তবে যেসব আইনি সংস্কার করা হয়েছে তা কীভাবে ব্যবহূত হবে, তার ক্ষমতা বোর্ডের ওপর দেওয়া হয়েছে। কাজেই বোর্ড কীভাবে এই আইনি পরিবর্তনটাকে ব্যবহার করে তা দেখার বিষয় বটে। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে ব্যাংকের গভর্ন্যান্সের ওপর। করোনাকালীন যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা আগামী ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়ে গেলে বোঝা যাবে সুবিধাগুলো কতটা নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের সার্বিক চিত্রও তখন অনুধাবন করা যাবে। তখন জানা যাবে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ কত এবং পুনঃ তপশিলিকৃত ঋণের পরিমাণই-বা কত। পুনঃ তপশিলিকৃত ঋণকে ডিস্ট্রেচ অ্যাসেট বা দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ বলা হয়। করোনাকালীন ঋণগ্রহীতাদের যেসব বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা গত ডিসেম্বর মাসে ওঠে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

নগরায়ণ সংস্কারের যে কথা বলা হয়েছে, সেখানে আপনি দেখবেন বিশ্বব্যাংক নাইট লাইট ডেটা ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করেছে। বাংলাদেশকে যদি রাতে আকাশ থেকে দেখেন, তাহলে দেখবেন কোথায় বাতি বেশি জ্বলছে তার ভিত্তিতে বোঝা যায় নগরায়ণটা কোন দিকে বা কোথায় বেশি হচ্ছে। দেখা গেছে, ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বাইরে যেসব শহর গড়ে উঠেছে তা ন্যাশনাল হাইওয়ে এবং রিজিওনাল হাইওয়ের আশপাশেই গড়ে উঠেছে। ফিজিক্যাল কানেকটিভিটির সঙ্গে নগরায়ণের একটি সম্পর্ক লক্ষণীয়। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো শহরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কাজেই আমাদেরকে নগর বিকেন্দ্রীকরণের দিকে যেতেই হবে। কাজেই সারা দেশব্যাপী কানেকটিভিটি বাড়াতে হবে। যমুনা ব্রিজ নির্মিত হবার পর তার আশপাশে অনেক নগর গড়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকার বিভিন্ন শহর গড়ে উঠবে। একই সঙ্গে ডিজিটাল কানেকটিভিটি বাড়াতে হবে। ডিজিটাল কানেকটিভিটি বাড়ানো গেলে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো শহরে ঢাকার আবশ্যকতা অনেকটাই কমে যাবে। শহরে থাকার জন্য যে সেবাগুলো প্রয়োজন হয় যেমন—পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বাইরে সড়ককেন্দ্রিক যেসব শহর আছে তাতে যদি এসব সেবা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ঢাকার ওপর চাপ অনেকেটাই কমবে।

শহরের উৎপাদনশীলতা পল্লি এলাকার উৎপাদনশীলতার চেয়ে অনেকে বেশি। শহরে তুলনামূলক কমসংখ্যক মানুষ বাস করলেও জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রামের চেয়ে শহরের অবদান বেশি। ঢাকা শহরের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, মোট জিডিপির ২০ শতাংশ বৃহত্তর ঢাকা থেকে আসে। কারণ এখানে উৎপাদনশীলতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। কাজেই দেশের বিভিন্ন স্থানে আমরা যদি আধুনিক নগর গড়ে তুলতে পারি, তাহলে নগরের যে উৎপাদনশীলতা বেশি তাকে কাজে জাতীয় অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙ্গা করা সম্ভব।

পরিকল্পিত নগরায়ণের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। নগর বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে বড় দুটি নগর। কিন্তু এই নগর দুটি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। কোনোভাবেই ঢাকা বা চট্টগ্রাম উন্নত বিশ্বের আধুনিক শহরের মতো নয়। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। কোথাও-বা হাসপাতাল গড়ে উঠছে। কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে। এত আবাসিক এলাকায় থাকার যে সুবিধাগুলো তা পাওয়া যাচ্ছে না। আবাসিক এলাকাতেও যানজট সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। কোনোভাবেই যানজটের সমস্যা অ্যাড্রেস করা যাচ্ছে না। যেসব নগরী ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে সেখানে হয়তো বেশি কিছু করার নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে যেসব নতুন নগরী গড়ে উঠবে তা যেন একই মডেলের না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এখন থেকেই পরিকল্পিত নগরী তৈরির জন্য কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

নতুন পরিসংখ্যান বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ শহরে বাস করে। অনেকেই বলেন, শহরগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে ৬০ শতাংশ অবদান রাখে। এই পরিসংখ্যান আসলে কিছুটা হলেও অনুমাননির্ভর। তবে শহরগুলো দেশের জিডিপিতে ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে এ নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক বা দ্বিমত নেইলে। বিশ্বব্যাংক শহরের পরিসংখ্যান বা অবদানের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা নাইট লাইট ডেটা ব্যবহার করে নির্ধারণ করা হয়েছে।

লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক লিড

ইকোনমিস্ট, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস

অনুলিখন :এম এ খালেক

 





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/630704/%E0%A6%86%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%96%E0%A7%81%E0%A6%AC%E0%A6%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%9C%E0%A6%A8

Sponsors

spot_img

Latest

PlayStation Plus adds Grid Legends and other May titles today

Connect with top gaming leaders in Los Angeles at GamesBeat Summit 2023 this May 22-23. Register here. PlayStation announced which games are coming to...

Browse the Internet Safely and Freely with This VPN, Just $35 Through December 3

Disclosure: Our goal is to feature products and services that we think you'll...

Jordan Walsh makes a splash in his Boston Celtics Las Vegas Summer League debut

Boston Celtics rookie wing Jordan Walsh put on a show in his Las Vegas Summer League debut for the Celtics in the team’s...

Ivica Zubac with a dunk vs the Phoenix Suns

Ivica Zubac (LA Clippers) with a dunk vs the Phoenix Suns, 04/25/2023 Source link: https://sports.yahoo.com/ivica-zubac-dunk-vs-phoenix-045051163.html?src=rss

Irish-born Green Bay Packers ace’s advice for NFL hopeful Louis Rees-Zammit

The NFL is one of the most well-known sports leagues around the world. Pitting giant athletes up against almost Olympic-quality sprinters, American...