উত্তরাঞ্চলের পল্লি রাস্তার সীমাহীন দুরবস্থা!


দুই মাস পর আবারও গ্রামে গেলাম। সেবার ছিল দারুণ খরা, সবকিছু শুকনো। এবার অঝোরধারায় বৃষ্টি। তখন শুষ্ক মৌসুম থাকায় রাস্তার ভাঙাচোরা অবস্থা নিয়ে বেগ পেতে হয়নি। সে সময় ধুলোবালুতে রাস্তার ভাঙা জায়গাগুলো ঢাকা পড়ে যাওয়ায় তার ওপর দিয়ে গাড়ি কোনো রকমে চলাচল করতে পেরেছিল। কিন্তু এবার কোরবনি ঈদের আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় ভাঙা জায়গাগুলো আরো বেশি ভেঙে গেছে। রাস্তার ঢালাই-পিচ উঠে গেছে। খোয়া, বালু ধুয়ে চলে গেছে নিচে। অগণিত খানাখন্দকে ভরা পথে কোনো যানবাহন নিয়ে চলাচল করা বিপজ্জনক।

গ্রামীণ জীবনের প্রধান পরিবহন অটোরিকশা, ভ্যান, ভটভটি, মোটরসাইকেল সেই সব পথে গিয়ে উলটে যাওয়ার ভয়ে চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় মানুষের ভোগান্তি বেড়ে গেছে। বর্ষায় চারদিকে কাদাপানি জমে যাওয়ায় মাঠের মধ্য দিয়ে পায়ে চলার বিকল্প সোজা পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন যাবত্ এসব রাস্তা ও ব্রিজ-কালভার্ট মেরামত না করায় এসব পল্লি সড়ক এখন মানুষের গলার কাঁটা। কেউ কেউ বলছেন, আমাদের আগের কাঁচা রাস্তাই ভালো ছিল। লেখক নিজেও এর ভুক্তভোগী।

দই মাস আগে বলা হয়েছিল, শিগিগর সব পল্লি রাস্তার সংস্কারকাজে হাত দেওয়া হবে। বর্ষা আসার আগে কাজ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সেরকম কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বছর আগে তৈরি করা বা সংস্কারকৃত চারদিকে অধিকাংশ রাস্তাই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অটোরিকশা, ভ্যান, ভটভটি চালকদের গাড়ি নষ্ট হচ্ছে এবং আয়-রোজগার কমে গেছে। বহু দূর ঘুরে ১০-১২ কিলোমিটার উলটো পথে চলাচল করতে গিয়ে সময় নষ্ট হচ্ছে। এজন্য ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে এবং যাত্রীদের সঙ্গে বস্চা করতে হচ্ছে।

এত দিনেও রাস্তাগুলো মেরামত শুরু করা হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে বলা হচ্ছে, আমাদের বাজেট নেই অথবা কেউ বলছেন বাজেট পাশ হয়নি। নির্মাণকাজে অসাধু চক্রের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়া আমাদের জাতীয় চরিত্রের অংশ। তারা সবাই মিলে নির্মাণকাজকে ক্ষণস্থায়ী রূপ দিতে বদ্ধপরিকর হওয়ায় আমাদের দেশে রাস্তাঘাটের করুণ দশা শুরু হয়েছে। আজকাল মি. পার্সেন্টেজ নামক নেতা, আমলা, ঠিকাদার, প্রকৌশলী প্রমুখের কথা ঠিকাদারগণ মানুষের কাছে গল্প করে বেড়ান। তবে কিছু সত্সাহসী প্রকৌশলী রয়েছেন, তারা এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে থাকেন।

এ প্রসঙ্গে একজন প্রকৌশলীর বক্তব্য থেকে কিছু কথা না বললেই নয়। সেই প্রকৌশলী তার স্বজাতি ভাইদের উদ্দেশে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কোনো একজন করিতকর্মা ঠিকাদার রাস্তা সুন্দর করে প্রিসাইজ করেছেন, তারপর রাস্তার ওপর কালো পলিথিন দিয়ে ছবি তুলে ইঞ্জিনিয়ারকে দেখিয়ে বিল তুলে নিয়েছেন। এ ধরনের মেধাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়! ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার পার্সেন্টেজ পেলেই হলো, তদারকির কোনো বালাই নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি প্রকৌশলী হিসেবে বলতে পারি, যদি সঠিকভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়, প্রকৌশলবিদ্যার সঠিক পরিমাপ অনুসারে, তাহলে ১০ বছর রাস্তাঘাট ভালো থাকার কথা। তাই নিজের চোখে দেখে এলাম, দুই বছর আগে যে রাস্তা হয়েছে, তা এখন চলার অনুপযোগী। … ইঞ্জিনিয়ার মহোদয় কদিন পরে ট্রান্সফার হয়ে যাবেন, তিনি তার নিজের পাওনা বুঝে পেলেই হলো। ঐ যে কথায় আছে না, কার গোয়াল কে দেয় ধোঁয়া!’

এটাই আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতা। যার ফলে রাস্তা নির্মাণের এক বছর না পেরোতেই সেগুলো ব্যবহারের অনুপোযুগী হয়ে পড়েছে। এমন অসংখ্য ব্রিজ নির্মিত হয়েছে, যেগুলোতে দুপাশের রাস্তায় কোনো সংযোগ নেই। বিলের থইথই পানির মধ্যে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে অব্যবহূত ব্রিজের কাঠামোগুলো। এগুলো কি জন অর্থের অপচয় নয়?

হাইওয়েতে অনেকটা স্বস্থির সঙ্গে চলাচল করার কথা ঘোষণা করা হলেও সেখানেও নির্মাণকাজে ঢিলেমি চোখে পড়ল। চালক কিছুক্ষণ ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি চালালেও দৌড়ে গিয়ে বারবার থেমে থাকাটা বেশ বিরক্তিকর মনে হচ্ছিল। জাতীয় মহাসড়কের প্রতিটি উপজেলা সদর বা বড় বড় বাজার এলাকায় আগের মতোই যানজট লক্ষণীয়। এসব এড়ানোর জন্য যে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে, তার শেষ মাথায় এসে পুনরায় অটোরিকশা ও গাড়ির জটলা চোখে পড়ল। অনেক জায়গায় ফ্লাইওভারের নিচে এবং শেষ মাথায় মাস্তানেরা দখল করে নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের দোকান করার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় সেখানে মানুষ ও গাড়ির জটলা কমেনি, বরং বেড়েছে। সেগুলো সরাতে অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশকে লাঠি হাতে সরব থাকতে দেখা গেল। কিন্তু এ দিয়ে সাময়িক কাজ হলেও সেটা নতুন ব্যাবসায়িক ফন্দি সৃষ্টি করে জনদুর্ভোগ বাড়াবে। তাই এজন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধে শক্ত অবকাঠামোব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

এছাড়া বড় বড় হাট-বাজার, বাণিজ্য এলাকা প্রভৃতিতে বাইপাস সড়ক নির্মাণ অতি জরুরি। কোনোরূপ বিকল্প পথ না থাকায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, রংপুরের মাহিগঞ্জ সাতমাথা, লালমনিরহাটের তিস্তা, মহেন্দ্রনগর ইত্যাদি এলাকায় সংকীর্ণ রাস্তায় গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানযটে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। মহেন্দ্রনগর থেকে ওকড়াবাড়ী-রাজপুর রাস্তা খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, অটোরিকশাও চলতে পারছে না। এছাড়া জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে নতুন ফোর লেন রাস্তায় কিছুক্ষণ ভোঁ-দৌড় দিয়ে আবারও পৌরসভা এলাকাগুলোতে দাঁড়িয়ে বিরক্তির মধ্যে সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফ্লাইওভার বানানো হয়নি।

খুব দৃষ্টিকটু বিষয় হলো, একবার রাস্তা সংস্কার শুরু হলে সেটা শেষ করা যেন ঠিকাদারদের মর্জির ব্যাপার। রাস্তা সংস্কার তাদের কাছে যেন শেষ না হয়ে ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা জনভোগান্তির কথা কোনো দিনই মনে হয় মাথায় নিতে পারেন না। আমাদের দেশে একশ্রেণির ঠিকাদার নিজেদের অর্থ দিয়ে কাজ শুরু বা সমাপ্ত করেন না।

অন্যদিকে অর্ধেক কাজ শেষ না হতেই বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর ফন্দি শুরু করে দেন। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে অসাধু প্রকৌশলী ও সরকারি কর্তৃপক্ষের লোকজন। পার্সেন্টেজ নেওয়া বা দেওয়ার এই অনৈতিক চর্চা এত বেশি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে যে, এর কারণে আমাদের দেশে নির্মাণকাজের খরচ জাপান বা ইউরোপের চেয়ে বহুগুণ বেশি এবং কাজের মান পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট পর্যায়ে চলে গেছে। তাই একটি রাস্তার কার্পেটিং ১০ বছরের আগে উঠে গেলে নির্মাতাদের জেল-জরিমানার বিধান থাকা উচিত। বর্ষাকালে মোট চার মাস সারা দেশে সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ ঘোষণা করা উচিত।

যে কোনো সৃষ্টি একদিন ক্ষয় হবে। এটাই শক্তির নিত্যতার রূপ। কিন্তু রাস্তাঘাটের উন্নয়ন এত দ্রুত ধসে যাবে কেন? এমন তো নয় যে পল্লি এলাকার সেই সব রাস্তায় প্রতিদিন ১০-২০ টন ওজনের ট্রাক চলাচল করে থাকে। মূল সমস্যা হলো, উন্নয়ন কাজের সংগ্রামে আমরা নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছি ক্ষমতার লোভ ও অতিরিক্ত অর্থলিপ্সার কাছে। কাজের মাঝপথে এস বাজেট ফেল করিয়ে খরচ বাড়ানোর মানসিকতা আইন করে বন্ধ করা উচিত। নির্মাতা চক্র বারবার খরচ বাড়ালে বারবার টাকার ভাগ পায়। তাই তারা এটাকে পেশার মধ্যে ধড়িবাজ চিন্তার অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছে। দ্রুত রাস্তা নষ্ট হলে তারা খুশি।

এই অসাধু চক্র দেশের রাস্তাঘাট নির্মাণের সব ঘাটে জাল বিস্তার করে ফেলেছে। তাই তাদের কাছ থেকে নতুন কাজ ও পুরোনো সংস্কারকাজের মানের মেয়াদ কমপক্ষে ১০ বছর ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি সংবলিত আইনি চুক্তিনামা নির্ধারণ করে কর্মাদেশ ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। সরকারি বাজেট সংকোচনের এই সময়ে এ ধরনের কর্মাদেশ ব্যবস্থাপনা চালু করা খুবই জরুরি। মানুষ ক্ষণস্থায়ী উন্নয়ন চায় না, টেকসই উন্নয়ন চায়।

দেশের পল্লি অঞ্চলের পুরোনো কাঁচা রাস্তাগুলো কোনো রকম পরিবর্তন না করেই পাকা করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল। ফলে সরু, নিচু, অপ্রশস্ত ও হাজারো বাঁকসহ এসব রাস্তায় যান্ত্রিক গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। রাস্তা থেকে উভয় পাশের ১০-১২ ফুট ফাঁকা রেখে ঘর বা স্থাপনা তৈরির নিয়ম থাকলেও কেউ সেটা মানেনি। ভয়ংকর বাঁকগুলো ঘেঁষে  কোথাও কোথাও এক ফুটও খালি না রেখে মানুষের ঘর, গাছ, খুঁটি, পুকুর থাকায় গাড়ি ঘোরানো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বাঁকগুলোতে কোথাও ফ্রন্টভিউ মিরর নেই। এসব বিপজ্জনক আনস্মার্ট পল্লিরাস্তা সরেজমিন পরিদর্শন করে আশু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

শুধু উত্তরের পল্লি রাস্তার দুরবস্থাই নয়, সারা দেশের রিমোট এলাকার কার্পেট বিছানো রাস্তাকে সুরক্ষা করে জনকল্যাণে একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় বা কমপক্ষে ১০ বছর ব্যবহারের উপযোগী করে রাখতে হলে সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরি করে নির্মাণকাজের দুর্নীতিকে অচিরেই রুখতে হবে। একজনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স অনভিজ্ঞ অন্যজনকে বেনামে ব্যবহার করতে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/652080/%E0%A6%89%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%80%E0%A6%A8-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE

Sponsors

spot_img

Latest

Johnson rescues Forest in crucial Everton draw

Brennan Johnson struck twice to earn Nottingham Forest a vital 2-2 draw against fellow strugglers Everton in the battle for Premier League survival.Steve...

Elon Musk says Twitter will start ‘purging’ dormant accounts

According to Twitter owner Elon Musk, Twitter is planning to purge accounts. No, not accounts belonging to extremists, neo-Nazis, or spreaders of disinformation.Twitter...

Do Not Apply A ‘One-Size-Fits-All’ Approach To Your Marketing

A common mistake that many companies make is using a “one-size-fits-all” approach to its marketing efforts. Said another way, the company comes up...

Caroline Wozniacki tells thing she totally gets now but before it was stunning to her

Caroline Wozniacki tells thing she totally gets now but before it was stunning to her © Getty Images Sport - Sarah Stier Caroline Wozniacki...

Sebastian Korda returns to action after three months

World no. 28 Sebastian Korda is ready to compete again after staying away from the court for three months due to an...