একদিন আচানক মৃণালের ভুবনে


আজ শত-বছরে পা রাখলেন মহান চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। তিনি এই বাংলাদেশের ছেলে। ১৯২৩ সালের ১৪ মে তিনি জন্ম নেন ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী মহল্লায়। মৃণাল সেনকে প্রথম দেখি কলকাতার নন্দনে, ২০০৩ সালে। নন্দন-১-এর প্রেক্ষাগৃহের সামনে দোতলার ব্যালকনিতে একা একা দাঁড়িয়ে তিনি। হাতে সিগারেট। আমি সাহস করে ভেবেছিলাম এগিয়ে যাই, পরিচয় দিই। কিন্তু মনে হয়েছিল ভিড়ে-ভরা প্রেক্ষাগৃহ থেকে তিনি ঐ নির্জন জায়গাটুকু বেছে নিয়েছেন একটু একা থাকার জন্য। ‘নিজের সঙ্গে একা থাকা’র সময়টা বড়মানুষদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধ্যানস্থ থাকার ঐ চমৎকার মুহূর্তটি আমি তাঁর কাছে গিয়ে নষ্ট করতে চাইনি। তাঁকে ভালোবাসি, আমার প্রতি তিনি বিরক্ত প্রকাশ করলে সেটা আমার জন্য খুব কষ্টের হবে। শুনেছি তিনি খুব রাশভারী।

এরপর ২০০৯ সালে আসে এক মোক্ষম সুযোগ। মৃণাল সেন সাংবাদিকদের সঙ্গ একদমই পছন্দ করেন না। কিন্তু আমি ঐ ‘সাংবাদিক’ হয়েই তাঁর সঙ্গে দেখা করার অ্যাসাইমেন্ট পেলাম। আমি তখন নতুন যে পত্রিকাটিতে যোগ দিয়েছিলাম, পত্রিকার সম্পাদক আবেদ খান জানালেন—মৃণাল সেনের একটি শুভেচ্ছাবার্তা চাই। তারপর সঙ্গে যোগ করলেন—দেখ তুমি একখানা সাক্ষাৎকারও নিতে পার কি না। আমাদের যোগাযোগের ক্লু ছিলেন মৃণাল সেনের সর্বশেষ ছবি ‘আমার ভুবন’-এর কাহিনিকার আফসার আমেদ। কবি শামীম রেজা ভাই আফসার আমেদ ভাইকে ম্যানেজ করেন। তারপর এক সন্ধ্যায় আফসার আমেদের সঙ্গে মৃণাল সেনের বাড়িতে গেলাম আমি ও আমার স্ত্রী শর্মিষ্ঠা। আফসার ভাই যেতে যেতে বললেন, দাদার সঙ্গে কথা বেশি বলবেন না। খুব মুডি মানুষ। বুঝেশুনে কথা বলবেন। শুনে আমার পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করল!

ঘটনাক্রমে আমার জন্মও ফরিদপুরে এবং ঐ ঝিলটুলী মহল্লাতেই। মৃণাল সেনের জন্মভিটা থেকে আমার বাড়ি মাত্র ছয়-সাত মিনিটের হাঁটাপথ দূরত্বে। মৃণাল সেন ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে একবার ফরিদপুরে এসেছিলেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ির পেছনে একটি পুকুর ছিল, যেখানে ডুবে মারা গিয়েছিলেন তাঁর অতি আদরের ছোট বোন ‘রেবা’। সেই পুকুরপাড়েই সমাধি দেওয়া হয় ছোট্ট রেবাকে। মৃণাল সেনদের বাড়িটিতে পরবর্তী সময়ে যাঁরা নিয়মমাফিকভাবে বসবাস শুরু করেন তারা ঐ সমাধি নষ্ট করেননি। মৃণাল সেন ফরিদপুরে গিয়ে ঐ মজা পুকুরপাড়ের জংলা সমাধিক্ষেত্রের সামনে বসে অঝোরে কেঁদেছিলেন। আমি সাক্ষাতের শুরুতেই আমার পরিচয় দেওয়ার পর সেই প্রসঙ্গ তুললাম। তিনি বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমার বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছিল, ভাবছিলাম তাঁর ধমকের তোড়ে তলিয়ে যাব কি না! কিন্তু ‘রেবা’ যেন আমাকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিলেন! মনে হচ্ছিল, আমি প্রথম পরিচয়ে প্রথম কথাতেই তাঁর হৃদয়হরণ করে ফেলেছি। যদিও তিনি জাতীয়তাবোধের বিপরীত মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন দেশ-কালের সীমিত গণ্ডির বাইরে। গরিব আর অধিকার বঞ্চিত মানুষের না-বলা ভাষা ছিল তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষা। এজন্য তিনি ‘মাটির মনিষ’ নির্মাণের জন্য ছুটেছেন ওড়িশার গ্রামে, ‘ভুবন সোম’ করতে আসন গেড়েছিলেন গুজরাতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ‘ওকা উড়ি কথা’ বা ‘কফন’-এর সময় তেলেঙ্গানার অজপাড়াগাঁয়ে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। এজন্যই আমরা দেখতে পাই তিনি বিচিত্র ভাষায় ছবি বানিয়েছেন। গরিবদের নিয়ে, দারিদ্র্যের দংশন নিয়ে ছবি করেন বলে তিনি মনে করেন যে, দারিদ্র্যের নিজস্ব একটি ভাষা আছে। এ কারণে তিনি যদি আফ্রিকায় গিয়ে সোয়াহিলি ভাষায় ছবি করতে হতো, তাতেও তাঁর কোনো অসুবিধে হতো না।

সুতরাং আমার ভয় ছিল যে, তিনি তাঁর জন্মভিটার একজনকে ‘আপন’ ভাববেন, নাকি প্রথাগত ‘সাংবাদিক’ কোটায় ফেলবেন? মৃণাল সেন খসখস করে লিখলেন তাঁর শুভেচ্ছাবার্তা। তারপর উঠে গিয়ে তাঁর বুকশেলফ থেকে নিয়ে এলেন লালমলাটের রয়্যাল সাইজের একটি বই। বইটার ওপরে বড় বড় করে লেখা—‘মন্তাজ : লাইফ, পলিটিকস, সিনেমা’। লেখকের নাম মৃণাল সেন। মৃণাল সেন নস্টালজিক হয়ে পড়লেন। তিনি শোনাতে শুরু করলেন কত কথা। তাঁর সামনেই রেকর্ডার অন করলাম, মুখের কাছে তুলে ধরলাম। তিনি রেকর্ডার বন্ধ করতে বললেন না, বিরক্ত হলেন না। যেন চেনেন না ওসব যন্ত্র। কখনো আমার কাঁধে হাত রেখে, কখনো বইয়ের কোনো একটি পৃষ্ঠা খুঁজে খুঁজে বের করে শোনাতে লাগলেন তাঁর লাইফ পলিটিকস সিনেমার কথা। তার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা চলল, উঠে এলো বিচিত্র সব বিষয়। তিনি ভালোবাসতেন ফরিদপুরে তাঁর প্রতিবেশী একটি মুসলমান মেয়েকে। খুব প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, হিন্দু-মুসলমানদের উচিত বেশি বেশি করে অন্য ধর্মের ছেলেমেয়েকে বিয়ে করা। তাহলে সবাই সবার আত্মীয় হয়ে উঠবে, কেউ কাউকে শত্রু মনে করবে না।

তাঁর চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করলে তাঁর ছবি নিয়ে প্রচুর রিভিউ বা আলোচনা পাওয়া যাবে। শুধু এটুকু বলা যায় যে, মৃণাল সেন সেইসব পরিচালকের একজন, যিনি সর্বদাই কৃত্রিম কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে চেয়েছেন তাঁর পরিচিত ভুবনের।

জন্মশতবর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে অভিবাদন জানাই বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই মহান নির্মাতাকে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার

 





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/643714/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%95-%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A3%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%87

Sponsors

spot_img

Latest

Alexander Zverev reacts to findings of ATP’s investigation: Justice has prevailed

Alexander Zverev says "the justice has prevailed" after the ATP's investigation concluded that there is "insufficient evidence" to substantiate the domestic abuse...

Fan travelled 1200 miles to see Lionel Messi only to realise he hadn’t started playing for Inter Miami

A fan made a 1,200-mile trip to watch Inter Miami to try and see Lionel Messi in the flesh - but he is...

Netflix is about to crack down on account sharing in the US

Netflix is about to bring its fight against account sharing to the US. “In Q1, we launched paid sharing in four countries and...

As Elizabeth Holmes heads to prison for fraud, many puzzle over her motives

At 39, she seems most likely to be remembered as Silicon Valley’s Icarus — a high-flying entrepreneur burning with reckless ambition whose odyssey...