ওষুধের মাধ্যমে মাসিক নিয়মিতকরণ বা এমআরএম সেবা না পাওয়ায় দেশে প্রসূতি মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। অপরিকল্পিত গর্ভধারণের কারণে মাসিক বন্ধ থাকলে সর্বশেষ মাসিক হওয়ার ৭০ দিন পর নিয়ম মেনে এই ওষুধ খেলে মাসিক শুরু হয়। কিন্তু সচেতনতা, প্রচারণা ও সেবা প্রদানে অনীহার কারণে এমআরএম সেবা না পাওয়ায় দেশে অনেক প্রসূতিই ভুল পদ্ধতিতে গর্ভনিরোধ করতে গিয়ে মৃত্যুর শিকার হন। নারীপক্ষ পরিচালিত মানসম্মত এমআরএম সেবা ব্যবস্থাবিষয়ক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার নারীপক্ষের ধানমন্ডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক কর্মশালায় গবেষণার ফল তুলে ধরার পাশাপাশি এ বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটি। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন নারীপক্ষের প্রকল্প সমন্বয়কারী সামিয়া আফরিন। উপস্থিত ছিলেন নারীপক্ষের সদস্য সাবিনা ইয়াসমিন, নাজমুন নাহার ও অন্যান্য।
আলোচনায় জানা যায়, দেশে এমআর চিকিৎসা পদ্ধতি ১৯৭২ সাল থেকে সরকার স্বীকৃত। দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে এই সেবা পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে ১২টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এমআরএম ওষুধ তৈরি করে। কিন্তু সহজলভ্য ও কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও ঔষধ প্রশাসন ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির অবহেলার কারণে এমআরএম নিয়ে প্রচারণা কম। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের সেবা দেওয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি কারণে অনীহাও দেখায়। ফলে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ থেকে মুক্তি পাওয়ার নিরাপদ পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও অনেক নারীই হাতুড়ে চিকিৎসক, কবিরাজ, অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে গর্ভপাত করাতে যান। ফলে অনেকেরই মৃত্যু হচ্ছে। আবার কেউ কেউ প্রাণে বেঁচে গেলেও ভুগছেন দীর্ঘ শারীরিক জটিলতায়। ছয়টি জেলার ১৫টি উপজেলা ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এই জরিপ পরিচালনা করে তারা।
জরিপে জানা গেছে, বেশির ভাগ সন্তান ধারণক্ষম নারী এবং কম বয়সি ও নতুন যৌনকর্মীরা এমআরএম বিষয়ে জানেন না। অনেকেই এর-ওর মুখে শুনে এই ওষুধ কিনতে আসেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী নিজে নন, পুরুষ বা পরিবারের অন্যান্য সদস্য এটি কেনেন। স্বাস্থ্য সেবাদানকারীদের এমআরএম-বিষয়ক নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিলেও সামাজিক ও ধর্মীয় নানা কারণ দেখিয়ে সেবা দিতে অপারগতা প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া ওষুধ বিক্রেতাদের এমআরএম বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ এবং জাতীয় এমআরএম নির্দেশিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এমআরএম ওষুধ সরবরাহ অপর্যাপ্ত এবং সেবাদানকারীদের আচরণও নেতিবাচক। এছাড়া সরকারি পর্যায় থেকে পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নেই কাউনসেলিংয়ের ব্যবস্থা। সামিয়া আফরিন বলেন, গর্ভধারণের ১৬ সপ্তাহ পর পর্যন্ত জরায়ুতে একটি রক্তপিণ্ড হিসেবে থাকে। ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শে এসব ওষুধ খাওয়া নিরাপদ। তবে তা নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে খেতে হবে। কিন্তু দেশে অনেক জরুরি ওষুধের মতো এটিও প্রেসক্রিপশন ছাড়াও বিক্রি হয়। ঠিকমতো গাইডলাইন মেনে এ ধরনের ওষুধ না খেলে অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে অনেকেই মারা যান এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতার মুখোমুখি হন।
এ বিষয়ে সচেতন করার দায়িত্ব পরিবারকল্যাণ পরিদর্শকের, কিন্তু তারাও অনেক সময় সচেতন করেন না নানা কারণে। এমআরএম খাওয়ার নিয়ম সর্বশেষ মাসিকের ৭০ দিন পর। কিন্তু দেখা যায়, নিয়ম না জানায় অনেকেই মাসিক বন্ধ হওয়ার ৭০ দিন পর খান। এতেও ওষুধের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। পরবর্তী সময়ে অনিরাপদ গর্ভপাত, ডিএনসির মতো জটিল পদ্ধতির দিকে যেতে বাধ্য হন অনেকে। কিন্তু শুরুতেই এমআরএম সেবা নিলে মাসিক নিয়মিতকরণের মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ধারণ করা যায়। সুইডেনভিত্তিক সংস্থা আরএফএইউর অর্থায়নে এশিয়ার পাঁচটি দেশে গবেষণা সম্বয়ের কাজ করছে মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান অ্যারো। আর বাংলাদেশে অ্যারোর পক্ষ থেকে গবেষণা পরিচালনা করছে নারীপক্ষ ও বাপসা। নারীপক্ষ অ্যাডভোকেসির দায়িত্ব পালন করছে। গবেষণার ফল নিয়ে ঔষধ প্রশাসন ও ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন সম্মতি জানিয়েছে বলে জানান সামিয়া আফরিন।