এল নিনো এবং আমাদের ভাবনা


এল নিনো শব্দের অর্থ ছোট ছেলে, এটি মূলত স্প্যানিশ ভাষার শব্দ। স্বাভাবিক অবস্থায় বাণিজ্য বায়ু (ট্রেড উইন্ড) প্রশান্ত মহাসাগরে নিরক্ষরেখা বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। এটি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উষ্ণ জল এশিয়ার দিকে নিয়ে আসে। এই উষ্ণ জলের পরিবর্তে সেই স্থলে ঠান্ডা জল সমুদ্রের গভীর থেকে উত্থিত হয়। এল নিনোর সময় পশ্চিমমুখী বাণিজ্য বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। বায়ুর চাপ এবং বাতাসের গতির পরিবর্তনের কারণে উষ্ণ পৃষ্ঠের জল নিরক্ষরেখা বরাবর পূর্ব দিকে, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে চলে যায়। উষ্ণ জলের আধিক্য ঠান্ডা জলের স্বাভাবিক উত্থান ঘটতে দেয় না। যার ফলে মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের অস্বাভাবিক উষ্ণতা লক্ষ করা যায় এবং বায়ুমণ্ডলীয় প্যাটার্নে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতীয় উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া। ইউএস ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুসারে এল নিনো গড়ে প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছরে ঘটে এবং শক্তিতে পরিবর্তিত হয়। সর্বশেষ শক্তিশালী এল নিনো ছিল ২০১৬ সালে। সে বছরই পৃথিবীতে গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ অনুভূত হয়েছিল। জার্নাল অব সাইন্সে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, এল নিনো সংঘটিত হওয়ার পরের পাঁচ বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি হতে পারে, যা একুশ শতকের শেষ নাগাদ গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৮৪ ট্রিলিয়ন ডলারে।

করোনা মহামারির প্রভাব, ডলারের ঘাটতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান সংঘাত এমনিতেই বিশ্ববাজারে সংকট ও মন্দাভাব সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহে তীব্র সংকট, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি এবং রিজার্ভ ঘাটতির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চলমান দাবদাহ। এমতাবস্থায় এল নিনোর প্রভাব যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে আরো তাতিয়ে দেবে, তা সহজে অনুমানযোগ্য। তবে প্রশ্ন আসতে পারে, এল নিনো কি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরো খারাপ করতে পারে? বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এল নিনোর সংগঠিত হওয়ার বছরগুলোতে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রায় শূন্য দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বেড়েছিল। এল নিনো পর্যায় শুরু হয়ে গেছে এবং বছরের শেষ নাগাদ যদি এল নিনোর প্রভাব প্রকট আকার ধারণ করে, তবে তা বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুত ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পর্যায়টি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। কারণ প্যারিস এগ্রিমেন্টে বিশ্বনেতারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন যে, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা  ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

প্রচণ্ড দাবদাহ যেমন জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তেমনি চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে জ্বালানিসংকটকে জটিল করছে। এল নিনোর প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে আগামী বছর অর্থাত্ ২০২৪, বিগত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে বিদ্যমান দাবদাহ অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে। এতে করে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি, জলবিদ্যুত্ উত্পাদন হ্রাস পাওয়া, প্রতি ইউনিটে শীতাতপযন্ত্র ব্যবহার বাড়ার ফলে লোডশেডিংয়ের সময় বাড়তে পারে। এছাড়া জ্বালানিসংকটের কারণে উত্পাদনব্যবস্থা ব্যাহত হলে রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে। ফলে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রধানত জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অভাব দেখা দিতে পারে।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এল নিনোর প্রভাবে অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে খরা দেখা দিতে পারে এবং ভারত তথা এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত উল্লেখযোগ্য হারে কমতে পারে। বৃষ্টিপাত কমলে খাদ্য উত্পাদন ব্যাহত হবে। এর প্রভাব আঞ্চলিক খাদ্য নিরপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। কৃষিজ উত্পাদন হ্রাস এ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় করা কঠিন হয়ে পড়বে। জীবিকার ভারসাম্য রক্ষায় তাদের হয়তো প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য কেনা কমাতে হবে, অথবা আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে  হবে। এটি দেশের বিদ্যমান আয়বৈষম্যকেও বাড়িয়ে দিতে পারে।

খাদ্যের সংকট, মূল্যস্ফীতি ও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া—এই সবকিছু একসঙ্গে মিলে সমাজে টানাপোড়েন বাড়তে পারে। তাছাড়া অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, আকস্মিক বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ঘটার পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়বে। এর ফলে উপকূলীয় জনজীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং সরকারের দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার ব্যয়ও বাড়বে।

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এল নিনো সম্পর্কিত জলবায়ুর ক্ষতিকারক প্রভাব হ্রাসের জন্য এখন থেকেই তোড়জোড় শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, পেরুর সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ও বিরূপ আবহাওয়া মোকাবিলার জন্য প্রায় ১ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। এই উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের লক্ষ্য হলো এল নিনোর সঙ্গে সম্পর্কিত জলবায়ু পরিবর্তন এবং আবহাওয়ার ঘটনা—এ উভয় থেকে উদ্ভূত ক্ষতিকর পরিণতিগুলো সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা ও শ্রশমিত করা।

যেখানে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩-২৪ মৌসুমে তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং বিশ্ব জলবায়ু ভঙ্গুর অবস্থায় পতিত হতে পারে, সেখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বর্তমান বাজেটে বিষয়টি মাথায় রেখেছেন কি? সম্ভবত, না।

চলমান অর্থবছর, অর্থাত্ ২০২৩-২৪-এ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং এর তীব্রতা কমাতে বাংলাদেশ সরকার ৩৭ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। বাজেট নথি অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত বরাদ্দ কমেছে ১৬৭ দশমিক ২৩ কোটি টাকা। অথচ আমাদের সামনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে এল নিনো সম্পর্কিত জলবায়ু পরিবর্তনকে আমলে নিয়ে জলবায়ু বাজেট প্রণয়ন করা এবং তা দিয়ে বিশ্ববাসীর সম্মুখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে জলবায়ু-সহনশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য সরকারের বার্ষিক বাজেট পরিকল্পনায় এল নিনোর আসন্ন প্রভাব বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এল নিনো একটি জলবায়ু ঘটনা, যা প্রশান্ত মহাসাগরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেশি উষ্ণতার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, যা বাংলাদেশের আবহাওয়ার ধরন এবং কৃষি উত্পাদনশীলতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের উত্পাদনের ওপরও। আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা হচ্ছে, এটি ১৯৯৭-৯৮ সময়কার সুপার এল নিনোর মতো ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে  পারে। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া এল নিনোর ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সৃষ্ট তীব্র ঝড়, তাপপ্রবাহ, দাবানল, বন্যা, তুষারপাত ও খরার মতো ধ্বংসাত্মক বিপর্যয়গুলো অসংখ্য প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি এবং যথেষ্ট আঘাতের কারণ হয়েছিল।

বৈশ্বিক এই দুর্যোগকে বিবেচনায় রেখে জলবায়ু বাজেট করা কতটা দরকার, তা এখনই ভাবার সময় এসেছে। পেরুর অর্থমন্ত্রী অ্যালেক্স কনটেরাস হিসাব করেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে জলবায়ুজনিত অর্থনৈতিক প্রভাব পেরুর মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ । ২০২২ সালের জিডিপি অনুসারে যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৪ বিলিয়ন ডলারে। আর এল নিনো সৃষ্ট জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পেরু সরকার বরাদ্দ করেছে ১ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার, যা প্রাক্কলিত সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির ২১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও তার সম্ভাব্য ক্ষতির ২০ শতাংশ বিনিয়োগের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এর পাশাপাশি অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এবং দীর্ঘ মেয়াদে এল নিনোর সম্ভাব্য প্রভাবকে আমলে নিয়ে কোন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়, তা নিয়ে এখন থেকে কাজ শুরু করা। এ বিষয়ে যত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল।

লেখক: গবেষক (অর্থনীতি বিভাগ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট, ঢাকা





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/651626/%E0%A6%8F%E0%A6%B2-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8B-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE

Sponsors

spot_img

Latest

Report: Warriors optimistic for quick Steph return after clean MRI

Report: Warriors optimistic for quick Steph return after clean MRI originally appeared on NBC Sports Bay AreaThe Warriors received a positive update on...

Indian Wells statement on Rafael Nadal withdrawal and fair move toward ticket-buyers

© Getty Images Sport - Sean M. Haffey Indian Wells Masters tournament director Tommy Haas highlighted Rafael Nadal will be greatly missed in...

Key Republican recruits hesitate to jump in if Trump is the nominee

Many of their prospective recruits are wary of running alongside Trump, who dominates the spotlight, repels crucial independent voters and forces his fellow...

‘The doctors have advised me to be…’

Tennis icon Roger Federer was in New York on Sunday watching the game between the Brooklyn Nets and the Boston Celtics from...

This Highly Profitable Bitcoin Cross Has Just Formed Again

On-chain data shows that a Bitcoin cross that has proved quite profitable has once again formed for the cryptocurrency. Bitcoin Realized Price Of Short-Term...