সম্প্রতি হইচই ফেলে দিয়েছে সুইজারল্যান্ডের একদল বিজ্ঞানীর তৈরি মস্তিষ্ক-সঞ্চালক যন্ত্রটি। দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ড ভেঙে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এক যুবক। সুইচ যন্ত্রটির সাহায্যে প্রায় ১০ বছর পরে উঠে দাঁড়িয়েছে যুবকটি। হাঁটতেও শুরু করেছে। প্রযুক্তির বিপ্লব চলছে বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সম্প্রতি এ বিপ্লবে অংশ নিয়েছে ইলন মাস্কের স্টার্টআপ কোম্পানি ‘নিউরোলিংক’। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মস্তিষ্ক, স্নায়ু ও পেশিকে নতুন করে সংযুক্ত করতে সাহায্য করবে এই কোম্পানির ‘ব্রেন-ইমপ্ল্যান্ট’ কার্যক্রম। ইতিমধ্যেই আমেরিকার এফডিএ মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে তাদের। সংস্থাটি একটি বিশেষ যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করছে, যার মাধ্যমে মানুষ নিজের মস্তিষ্কের সাহায্যে কম্পিউটার ইন্টারফেস নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। নিউরোলিংকের ব্যাখ্যা—এ যন্ত্রের সাহায্যে কোনো ব্যক্তির হারানো দৃষ্টিও ফেরানো সম্ভব। এতে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা কোনো ব্যক্তিও নতুন করে হাঁটতে পারবে। সার্জিক্যাল রোবটের সাহায্যে রোগীদের মস্তিষ্কে যন্ত্রটি প্রতিস্থাপন করা হবে। ১৯৪০-এর দশকে চার্চ এবং টুরিংয়ের গণনাতত্ত্বের ভিত্তিতে যার চর্চা শুরু হয়েছিল একেবারেই একাডেমিক পরিসরে বিজ্ঞানপিপাসু মানুষের চিন্তার মধ্যে, ২০২৩-এ সেই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধা হয়ে উঠল প্রযুক্তি দুনিয়ার এক অবিসংবাদী নিয়ন্ত্রক শক্তি। কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রকে মানুষের মতো বুদ্ধিমান করে তোলা ছিল কৃত্রিম মেধার প্রাথমিক লক্ষ্য। মেধাসম্পন্ন যে কোনো প্রাণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিখে নেওয়ার ক্ষমতা। আজকের এই প্রযুক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায় হলো যন্ত্রের শিখে নেওয়ার ক্ষমতা। যন্ত্র আজ শিখছে, আর তা থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। মেশিন লার্নিংয়ের হাত ধরে বিপুল তথ্যের সমুদ্র মন্থন করে এ যন্ত্রগুলো শিখে ফেলছে এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ফুসফুসের ডিজিটাল এক্সরে পরীক্ষা করে বলে দিতে পারছে রোগীর ক্যানসার হতে পারে কি না! সুরক্ষিত করতে পারছে অনলাইন লেনদেন প্রক্রিয়াকে, স্রেফ আপনার মুখের কথাতেই বাড়ির আলো-পাখা থেকে স্মার্ট টিভি সেটিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে ‘এলেক্সা’ কিংবা ‘সিরি’-এর মতো যান্ত্রিক সহকারীরা।
ইউনেসকোর ‘২০২২ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইন এডুকেশন—হিয়ার, দেয়ার অ্যান্ড এভরি হোয়্যার’ রিপোর্টের মূল বিষয়বস্তু ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধা। রিপোর্টের সুপারিশে একটি বিশেষ দিক তুলে ধরা হয়েছিল, মানবসম্পদ উন্নয়নে কৃত্রিম মেধা প্রয়োগের নৈতিকতা বিচার নিয়ে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট বিস্ময়কর পূর্বাভাস দিয়েছে। ‘ফিউচার অব জবস’ শীর্ষক রিপোর্ট জানাচ্ছে, আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বে চাকরি হারাতে পারে প্রায় ৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। অন্যদিকে, ঐ সময়সীমার মধ্যে ৬ কোটি ৯০ লাখ নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে আগামী পাঁচ বছরে কাজ হারিয়ে পথে বসতে পারে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। সুইজারল্যান্ডের ‘দাভোসে’ সংস্থা প্রতি বছরই বিশ্ব নেতাদের নিয়ে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করে। এবারের আলোচনায় উঠে এসেছিল, ২০২৭ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুল ব্যবহারের ভালো দিক যেমন বিশ্ব দেখবে, তেমনি এর রয়েছে নেতিবাচক কিছু দিক। এর মধ্যে অন্যতম কর্মী সংকোচন। কারণ, এবার বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই কৃত্রিম মেধা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর জোর দিতে শুরু করেছে। ফলে কর্মীদের ওপর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ‘আইবিএম’ সেই পথে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। নতুন কর্মী নিয়োগ তো নয়ই, বরং কর্মী ছাঁটাই করে সে জায়গায় তারা কৃত্রিম মেধাকে ব্যবহার করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই জানা গেছে, ‘আইবিএম’ ৭ হাজার ৮০০ কর্মীকে সরিয়ে আগামীদিনে কৃত্রিম মেধা ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে। কৃত্রিম মেধার ভরসায় পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে ৫৫ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছে ব্রিটেনের নামি টেলিকম সংস্থা ‘বিটি’। এই সংখ্যা তাদের মোট কর্মচারীর সংখ্যার ৪০ শতাংশ। এরই মধ্যে ‘বিটি’র প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা ‘ভোডাফোন’ ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা ঘোষণা করেছে।
বাষ্প ও পানির শক্তি, রেলপথ ও টেলিগ্রাফ এবং ট্রানজিসটারের মাধ্যমে কম্পিউটার ও ডিজিটাল প্রযুক্তি—এ তিনটি শিল্পবিপ্লব পেরিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে আজকের দুনিয়া। এবারের বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি কৃত্রিম মেধা। যাকে ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ অর্থাত্ যন্ত্রে যন্ত্রে এক অভূতপূর্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা। ২০১৬ সালে সানফ্রানসিসকোতে আয়োজিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ প্রথম এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরে। কৃত্রিম মেধানির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উত্পাদন এবং শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের প্রক্রিয়ার অন্য নামই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এ প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে—এমন স্মার্ট মেশিন তৈরি করা, যা তথ্যনির্ভর স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার সমাধান করবে। তথ্যই বর্তমান দুনিয়ার নতুন পেট্রোল। সেই পেট্রোল পুড়িয়ে সভ্যতার চাকাকে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি করছে যে ইঞ্জিনটি, সেটাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। চতুর্থ বিপ্লবের অনেক ভালো গুণ এখনো পৃথিবী দেখে উঠতে পারেনি। চ্যাটজিপিটি পৃথিবীর মানুষকে কিছু কাজ দেখিয়ে ইতিমধ্যেই আভাস দিচ্ছে, ভবিষ্যতের কৃত্রিম মেধার দুনিয়াটা কতটাই না বৃহত্ হতে পারে! আমেরিকার এক যুবক (টিম বচার) বই লেখার কাজে কৃত্রিম মেধার চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে মাত্র কয়েক দিনে ১০০টি বই লিখে হইচই ফেলে দিয়েছে। সব কয়টি বই-ই তার উপন্যাস। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এতগুলো বই লেখার কাজটি কৃত্রিম মেধার চ্যাটজিপিটি সম্ভব করেছে।
মন্দ দিকটি হলো, পৃথিবীর ১ কোটি ৪০ লাখ কর্মী ছাঁটাই হয়ে বেকার হয়ে পড়লে তার চাপ পৃথিবী কীভাবে সহ্য করবে, সে ব্যাখ্যা এখনো কেউ দিতে পারেনি। অন্যদিকে যেমন সত্য যে, অপরিশোধিত পেট্রোল যেমন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় না— তেমনি তথ্যে যদি মিশে থাকে ভেজাল, সংগৃহীত তথ্যকে যদি করে তোলা হয় পক্ষপাতদুষ্ট—তাহলে কৃত্রিম মেধার আধুনিকতম মডেলগুলো সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছুবে, তা শুধুই মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। সুতরাং তথ্যভান্ডারে ত্রুটি, অসাম্য কিংবা পক্ষপাত থাকলে সেই তথ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল কৃত্রিম মেধাতন্ত্রের আসল বিপদ পৃথিবীর মানুষের কাছে ধরা দিতে পারে। কৃত্রিম মেধার নৈতিক দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে আওয়াজ তুলেছেন স্ট্যানফোর্ড ‘ব্ল্যাক ইন এ আই’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা টিমন্টি গেবরু, যার কাজের মূল বিষয়টিই কৃত্রিম মেধার নৈতিক দায়বদ্ধতা।
আগামীকাল সকালটা যদি ইলন মাস্কের নিউরোলিংক এই সংবাদ নিয়ে আসে—তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মস্তিষ্ক, স্নায়ু ও পেশিকে সংযুক্ত করে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা কোনো ব্যক্তিকে সোজা করে দাঁড়াতে এবং স্বাভাবিকভাবে হাঁটার সামর্থ্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে, তবে সেই সংবাদকে বিশ্ব কীভাবে ধারণ করবে? নিউরোলিংক কিংবা কৃত্রিম মেধা কাকে কাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে? ভাবতে ভালো লাগছে, আবার ভয়ও লাগছে। ওলটপালট করে দেবে না তো এতকালের সাজানো বিশ্বাসটুকু? তবে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, কৃত্রিম মেধার কাজকে যেভাবেই বিশ্লেষণ করুন, তার অস্তিত্বকে আর অস্বীকার করার সুযোগ পাচ্ছেন না। শুধু এখন দেখার পালা—তার দৌড় কতদূর যায়। দেখার পালা, তার কারণে ছাঁটাই হওয়া বিশাল কর্মীবাহিনীকে নতুন কাজ দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কৃত্রিম মেধা কীভাবে অবদান রাখে। দেখার পালা, ভুলত্রুটিযুক্ত কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যকে শোধিত করে নির্ভেজাল তথ্যভান্ডার তৈরি করে।
প্রশ্ন জাগছে নতুন করে, সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক কে হবে—বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অন্য কোনো শক্তি; না বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সমন্বিত পদ্ধতি? সেই কবেই প্রযুক্তিকে মৌলিক বিজ্ঞানের জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছিলেন ক্রিস্টোফার কডওয়েল তার বিশ্বনন্দিত বই ‘স্টাডিস ইন এ ডাইং কালচারে’। সেখানে তিনি বলেছিলেন, মৌলিক বিজ্ঞানকে বিপথে নিয়ে যাবে প্রযুক্তি। একটি সময় আসবে, যখন প্রযুক্তি হয়ে উঠবে মৌলিক বিজ্ঞানের হাতে গড়া ফ্র্যাংকেনস্টাইন।
কডওয়েলের তত্ত্ব বলে—প্রযুক্তি বিজ্ঞানভিত্তিক হতে পারে, কিন্তু সব প্রযুক্তিই বিজ্ঞান নয়! প্রযুক্তি বিজ্ঞানের হাত ধরেই আসতে পারে। কিন্তু তাই বলে তাকে বিজ্ঞান বলা যাবে না। বিজ্ঞান সব সময়ই বলে যে, বৈজ্ঞানিক সত্য কোনো স্থির সত্য নয়! এসব সত্য পরীক্ষানিরীক্ষার ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে। যেমন সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘুরে চলার মতো একটি চলমান সত্য—যা কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন হয়ে পূর্ণতা লাভ করে। বিজ্ঞান অপেক্ষা করে, শেষ কথা কে বলবে তার জন্য। কিন্তু এ ফাঁক দিয়েই ঢুকে পড়ে প্রযুক্তি। প্রযুক্তি সোজাসুজিভাবে চিহ্নিত করে ফেলে, স্থির করে ফেলে তাদের বিচারে সত্যের সন্ধান। সবকিছু তখন পালটে যেতে চায়। প্রযুক্তিই হয়ে পড়ে শেষ উত্তর। আজকের দিনের সেই শেষ উত্তরটিই দিয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম মেধা।
লেখক : কলামিস্ট