মুদ্রাস্ফীতির অতি সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে বিগত সময়ে ১০০ টাকা দিয়ে আমি যে পণ্য পেতাম এখন ১০০ টাকা দিয়ে একই পণ্য আরও কম পাচ্ছি। এতে সীমিত আয়ের লোকদের জীবন নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হয়। অনেক পণ্য কেনাকাটা বাদ দিতে হয় অথবা কম কিনতে হয়। বর্তমানে স্তিমিত তিন বছর মেয়াদি ‘ওমিক্রন সংক্রমণ’ এবং পরবর্তী সময়ে চলমান ‘ইউক্রেন সংকটের’ কারণে সৃষ্ট বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থার বিপত্তি, জ্বালানি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এই মূল্যস্ফীতির উল্লেখযোগ্য কারণ। মূল্যস্ফীতির প্রভাব অর্থনীতি ও সমাজজীবনে ব্যাপক। মুদ্রাস্ফীতির সুফল এবং কুফল দুটিই আছে। এ বিষয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির ছাত্রদের পরীক্ষায় প্রশ্নও আসে। মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ এবং এর পরিমাপ পদ্ধতি নিয়েও বিতর্ক আছে। সরকারি হিসাবেই আমাদের চলমান মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই হার ৩০, ৫০, ৭০ ও ১৩০ শতাংশ পর্যন্ত আছে।
বিশ্বপরিস্থিতির কারণে এমনটি হচ্ছে—বিষয়টি সরকার ও ব্যবসায়ের পক্ষ থেকে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলেও যেহেতু এই বিষয়ের মাধ্যমে জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, এই বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে, সরকার ও ব্যবসায়কে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। ব্যাংকের টাকা লুটপাট এবং কথিত বিদেশে পাচার, ঋণখেলাপির পরিমাণ বাড়লেও এতে সাধারণ জনগণের আপাতত সরাসরি কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। একজন গ্রাহকও বলতে পারবেন না, তিনি ব্যাংকের টাকা রেখেছিলেন; কিন্তু ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে টাকা পাননি। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের কারণে শতকরা একজন লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমনটি বলা যাবে না। প্রস্তাবিত উপাত্ত সংরক্ষণ আইনের কারণে ব্যক্তিবিশেষ তার উপাত্ত চুরি হওয়ার আতঙ্কেও নেই। বিভিন্ন প্রকল্পের বড় বড় দুর্নীতি ও ঘুষ দ্বারা দেশের ক্ষতি হলেও ক্ষীণদৃষ্টিতে ব্যক্তি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত মনে করেন না। মুদ্রাস্ফীতির কারণে যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তারা এ বিষয়কেই বেশি মনে রাখবেন। বিদ্যুৎ, সড়ক, সেতু, ট্যানেল, যোগাযোগ ও সরকারের অন্যান্য পরিষেবা থেকে যে উপকার পাচ্ছেন, সেটাকে ছাড়িয়ে যাবে মুদ্রাস্ফীতির ক্ষতি। মানুষ উপকার অপেক্ষা অপকার বেশি মনে রাখে। ২০০২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ক্যায়েনম্যান বলেছেন, ‘মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না, লাভের চেয়ে ক্ষতিকে অনেক বেশি ঘৃণা করে। উপকারের চেয়ে অপকারকে বেশি গুরুত্ব দেয়।…মানুষ পুরোনো অতীত ভুলে যায়, বর্তমানের প্রতি বেশি সংবেদনশীল।’
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আলোচনায় গণমাধ্যম এবং টেলিভিশনে অধিকাংশ আলোচনাতেই ক্রেতাদের দুর্দশার কথাই উঠে আসে। অন্য পক্ষগুলো, যেমন—শিল্পোত্পাদনকারী, ছোট ব্যবসায়ী, ছোট ও নতুন উদ্যোক্তা, এমনকি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমস্যা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। সীমিত আয়ের ক্রেতাদের মুদ্রাস্ফীতিজনিত দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি রেখেই আজকের বিষয় উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মার্কেটারদের সমস্যা আলোচনা করা।
বর্তমানে যে মুদ্রাস্ফীতি চলছে, তা শিগগির আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না। বৈশ্বিক পর্যায়ে সেটা ১৯৮০-র দশকের মুদ্রাস্ফীতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ের জন্যই এটা একটা দারুণ সংকট। ৪০ বছর আগে যারা (আকিজ সাহেব) এই মুদ্রাস্ফীতি দেখেছিলেন তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই, এখন যারা ব্যবসা করছেন, তারা (নাসির, বশির) কখনো এমন দুরবস্থা মোকাবিলা করেননি। বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপকগণ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সময় অতিক্রম করছেন। একসময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ১৪-১৫ শতাংশ হারে ব্যাংকের ঋণ পেলেও বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এখন সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদেও ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে চাইছেন না (যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি সেজে বিদেশে টাকা পাচার করতে চান, তাদের বাদ দিতে হবে।) তবে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়লেও এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কিছু ব্যবস্থাও দেখা যাচ্ছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনদের ইতিহাসের নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই ক্রান্তিকালে কোম্পানির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, ক্রেতা কী আচরণ করছেন বা করবেন এবং এর সঙ্গে বাজারজাতকরণ কৌশলের সমন্বয় করে তাদের কাছে ভ্যালু পৌঁছে দেওয়া এবং প্রতিযোগীদের সঙ্গে তার ভিন্নতা বজায় রাখা। এই সংকট মোকাবিলায় একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। সেটা হলো কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগকেই এই সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব দিতে হবে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময় কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের লোকদের কাজ হচ্ছে ক্রেতার অবস্থা অনুধাবন করে, ক্রেতার অবস্থা মূল্যায়ন করে উপযুক্ত কর্মকৌশল নির্ধারণ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় কৌশলী হচ্ছে, ‘কম খরচে ব্যবসা করা’। অধ্যাপক Michael Porter যেটাকে বলেছেন, ‘overall cost leadership’। এর জন্য যা করতে হবে:
(১) নির্মোহভাবে খরচ ও মুনাফা পর্যালোচনা করতে হবে।
(২) magnifzing glass দিয়ে খরচকে দেখতে হবে। ইতিমধ্যেই না করে থাকলে খরচ পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজনে ‘QuickBook’-এর মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে।
(৩) যদি সৃজনশীল হন। প্রয়োজনে খরচ স্থিতিশীল রাখার জন্য পণ্য ও সেবার সংখ্যা কমিয়ে দিন। যেমন—সপ্তাহে এক দিন সার্ভিস সেন্টার বন্ধ রাখুন। ক্রেতাদের জন্য সেলফ সার্ভিসের ব্যবস্থা করুন। যেমন— রেস্টুরেন্টে ছক পদ্ধতিতে বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করুন। (Domino’s ক্রেতা এসে পিজ্জা নিয়ে গেলে ডিসকাউন্ট দেয়। কিছু কিছু হোটেল অতিথি অনুরোধ জানালেই কেবল হোটেলের পক্ষে পরিচ্ছন্নতাকর্মী পাঠায়।)
(৪) লেনদেন প্রক্রিয়াটিকে সংক্ষিপ্ত এবং স্বয়ংক্রিয় করুন। প্রযুক্তির সাহায্যে কি কোনো কাজ করা যাবে, যা আপনি বা আপনার কর্মচারী করছে ? বড় ধরনের প্রভাব না হলে কিছু কাজ কি বাদ দেওয়া যাবে?
(৫) কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়ান। কর্মীদের সন্তুষ্টও রাখতে হবে। কর্মী হারানোর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। তাদের জন্য কার্যসম্পাদনভিত্তিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৬) অপচয় রোধ করে নির্মোহভাবে খরচ কমাতে হবে। এমন কিছু ক্রয় করবেন না, যা থাকলে আপনার ভালো লাগে (nice to have)। জিনিসটা কী কাজে লাগে, তা পরখ করে দেখুন। এমন কিছু কি কিনেছেন, যা আপনি শিগগিরই ব্যবহার করবেন না। কোথাও কি এমন চাঁদা দিচ্ছেন, যাদের সেবাটি এ সময়ে আপনার না নিলেও চলে।
(৭) জুম মিটিং করুন। সামনাসামনি ভ্রমণ করা বা দেখা হওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, ভেবে দেখুন। কৌশলগত খরচ এবং মামুলি ধরনের খরচের পার্থক্য নির্ণয় করুন।
(৭) যদি নিশ্চিত হন দাম আরও বাড়বে, সেক্ষেত্রে সুযোগ থাকলে এখনই কাঁচামাল মজুত করুন। বাল্ক/লট ধরে কিনুন।
(৮) মুদ্রাস্ফীতির সময় নগদ টাকা ধরে রাখলে লোকসান বাড়বে, নগদ দ্রুত অবমূল্যায়িত হয়। অপব্যবহারযোগ্য নগদ থাকলে ভবিষ্যতে ব্যবহারযোগ্য সম্পদ সংগ্রহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করুন। মুদ্রাস্ফীতি স্বল্প বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তবে চিরস্থায়ী হবে না। সুযোগ থাকলে ঋণ বা বাকিতে ক্রয়ের পরিশোধ বিলম্বিত করুন। এতে আপনার আর্থিক দায় পরিষদের পরিমাণ কমে যাবে। সরকার বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই সময়ে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, সুযোগ থাকলে সেটা নেওয়ার চেষ্টা করুন।
(৮) কোম্পানির বর্তমান ক্রেতাদের প্রণোদিত করুন। নতুন ক্রেতা ধরার চেয়ে পুরোনো ক্রেতাকে ধরে রাখার খরচ অনেক কম। কাস্টমার লয়ালিটি প্রোগ্রাম, বাট্টা এবং অন্যান্য অফার অব্যাহত রাখুন (Mitchell Leiman, ২০২২)।
বাজারজাতকরণ মিশ্রণ কৌশল
(১) পণ্য (product) :উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময়ে পণ্য ও ব্যবসায় খাতের সমন্বয় অব্যাহত রাখতে হবে। যে কোনো ব্র্যান্ডের মধ্যমণি হচ্ছে পণ্য। ব্র্যান্ডের অবস্থানের জন্য মৌলিক উপাদানই হচ্ছে পণ্য। এ সময়ের উদ্ভাবনই হতে পারে মূল ভরসা। ক্রেতার কথা শুনতে হবে, পণ্য হচ্ছে ক্রেতার সমস্যার একটি সমাধান। Big data বিশ্লেষণ করে ক্রেতাদের মনোভাব ট্র্যাকিং করা এখন অনেক সহজ। যেমন সুপার শপ থেকে পণ্য ক্রয়ের সময় ক্রেতারা কোন দিক থেকে কোন দিকে ঝুঁকছেন, তা আজকাল সহজেই জানা যায়। সেই অনুযায়ী পণ্য পোর্টফলিও সমন্বয় করতে হবে। উদ্ভাবনের জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।
অস্থিরতা (volatility) অনেক সময় সুযোগ নিয়ে আসে। ভিন্ন সেগমেন্টে কম খরচের সরবরাহকারী হিসেবে যাওয়ার কথা ভাবুন। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিতে বিরক্ত হবেন না। এতে আপনার দৃষ্টির বাইরে থাকা ক্রেতার সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন। এটা বাজারজাতকরণ প্রচেষ্টা কমানোর সময় নয়। ক্রেতাকে প্রদেয় আবশ্যকীয় সেবার ব্যাপারে অবহেলা করা যাবে না। বহু শিল্পে কাস্টমার সার্ভিসের ওপরেই ক্রেতার সন্তুষ্টি বহুলাংশে নির্ভর করে।
(২) মূল্য (Price) :সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। মূল্যবৃদ্ধিকে ক্রেতা, ডিলার, এমনকি নিজস্ব বিক্রয়কর্মীরাও ভালোভাবে নেয় না; তা জেনেশুনেই কোম্পানিগুলো মূল্য বৃদ্ধি করছে। মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও বিতরণ খরচ বেড়ে যাওয়া। ক্রমবর্ধমান খরচ কোম্পানির মুনাফাকে কমিয়ে দেয়, আর কোম্পানি তখন বাধ্য হয় নিয়মিত মূল্য বাড়াতে থাকে। কোম্পানি অনেক সময় খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে—এ আশঙ্কায় যতটুকু খরচ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে মূল্য বাড়ায়। কোম্পানিগুলো এ সময়ে সাধারণত তার ক্রেতাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি মূল্য চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায় না।
লেখক: অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়