পুনরায় অশান্ত হইয়া উঠিয়াছে সুদান। ২০১৯ সালের পর ২০২১, অতঃপর ২০২৩ আসিয়া অস্থিরতা ও অশান্তির পারদ চরমে উঠিয়াছে। গত কয়েক দিনে সুদানের সেনাবাহিনী এবং একটি আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে শতাধিক মানুষ নিহত এবং সহস্রাধিক আহত হইয়াছেন। দেশটির রাজধানী খার্তুমে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং সেনা সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ লইয়া দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলিতেছে ভয়ংকরভাবে। সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে এই লড়াই প্রথমে ওমদুরমানে শুরু হইলেও অচিরেই তাহা রাজধানী খার্তুমের উপকণ্ঠে পৌঁছাইয়া যায়। আরএসএফ ঘোষণা করিয়াছে, তাহারা প্রেসিডেন্টের বাসভবন, সেনাপ্রধানের বাসভবন, দেশের জাতীয় টেলিভিশন সম্প্রচার সংস্থার দপ্তর এবং খার্তুমের বিমানবন্দরের দখল করিয়া লইয়াছে। যদিও সুদানের সেনাবাহিনী ইহা স্বীকার করে নাই। সুদানের সেনাবাহিনীর প্রধান আবদেল ফতেহ আল বুরহান জানিয়েছেন, খুব শিগিগরই প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দখল লইবে সেনাবাহিনী। সুদানের রাজধানী খার্তুমের বাসিন্দাদের সতর্ক করিয়া সুদানের বায়ুসেনাবাহিনী জানাইয়াছে, সুদানের বাসিন্দারা যেন বাড়ির বাহিরে না বাহির হন। কারণ, আকাশপথে বিমানবাহিনী টহল দিতেছে, প্রয়োজনে সন্দেহজনক জায়গায় তাহারা হামলা করিবে। বিদেশি গণমাধ্যমে ইহা প্রকাশ পাইয়াছে যে, ইতিমধ্যেই সুদানের আধাসামরিক বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা চালাইয়াছে সেনাবাহিনীর বিমান। বাহ্যত মনে হইতেছে, উভয় পক্ষের শক্তির লড়াই সহজে শেষ হইবে না।
প্রশ্ন জাগিতেছে, কেন এই সংঘাত? ইহার উত্তর খুঁজিতে আমাদের ফিরিয়া যাইতে হইবে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে। সেই সময় গণবিক্ষোভের ভিতর দিয়া সুদানের প্রেসিডেন্ট আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হয়। অবসান হয় তাহার ৩০ বৎসরের মহাপ্রতাপশালী শাসনের। তখন বুরহান ছিলেন সেনাবাহিনীর মহাপরিদর্শক। সেই সময় সুদানের সবচাইতে জ্যেষ্ঠ জেনারেলদের মধ্যে বুরহানের অবস্থান ছিল তৃতীয়। তখন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল (টিএমসি)। বুরহানকে এই টিএমসির প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। কয়েক মাস পর বিভিন্ন চাপের মুখে টিএমসি পরিবর্তন করিয়া গঠন করা হয় সার্বভৌম পর্ষদ (এসসি)। সামরিক-বেসামরিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতেই গঠিত এই পর্ষদ। এই পর্ষদই ২০১৯ সাল হইতে সুদান চালাইতেছে। সার্বভৌম পর্ষদে প্রধান বুরহান এবং উপনেতা আরএসএফের প্রধান হেমেদতি। সার্বভৌম পর্ষদের নেতা হিসাবে বুরহান কার্যত সুদানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। এই পর্ষদ দেশটির গণতন্ত্রপন্থি বেসামরিক শক্তিগুলির সহিত একত্রে কাজ করিয়া আসিতেছিল। অতঃপর দুই বৎসর পার না হইতেই ২০২১ সালে বুরহান ও হেমেদতি অভ্যুত্থান করিয়া বসেন। তাহারা সর্বতোভাবে দখল করেন সুদানের ক্ষমতা। সুদানের কার্যত প্রধান নির্বাহী হিসাবে বুরহান নিজের ক্ষমতা সুসংহত করিতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন; কিন্তু সকল শক্তিশালী পক্ষের মধ্যেই ক্ষমতার স্বাদ পাইবার উদগ্র বাসনা দেখা দেয়। উহা যেন বাঘের নরমাংসের স্বাদ পাইবার মতো উদগ্র আকাঙ্ক্ষা! সেই কারণেই সম্প্রতি সুদানে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়াইয়া পড়িয়াছে সামরিক বাহিনী ও আরএসএফ। বলা যায়, সুদানে সর্বশেষ সহিংসতার মূলে রহিয়াছে বুরহান ও হেমেদতি পক্ষের মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়েরই বহিঃপ্রকাশ। ইতিপূর্বে সুদানে একটি বেসামরিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিবার জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে মতৈক্যে পৌঁছানোর একটি চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। আরএসএফের ১ লক্ষ সদস্যকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করিবার প্রশ্নটিও ছিল অন্যতম প্রধান সমস্যা। সাম্প্রতিক সমস্যায় অনেক এয়ারলাইনস খার্তুমে তাহাদের ফ্লাইট বাতিল করিয়াছে। সুদানের সহিত সীমান্ত বন্ধ করিয়া দিয়াছে প্রতিবেশী দেশ চাদ।
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কতভাবে কত ফর্মে হইতে পারে, ঘরের মধ্যে আপাতমিত্র কখনো ভয়াবহ শত্রুতে পরিণত হয়, বাহির হইতে কত ধরনের ষড়যন্ত্র হয়—বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভ্যুত্থান, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে আমরা বেশ কিছু সাদৃশ্য দেখিতে পাই। সেইখান হইতে শিক্ষা লইবারও অনেক আলামত দেখিতে পাওয়া যায়।