দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন ইয়াবার বড় চালান টেকনাফ সীমান্তে এ দেশের গডফাদারদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। পরে টেকনাফে থাকা অর্ধশতাধিক ইয়াবার গডফাদার ঐ চালান রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে দেন।
ইয়াবাসম্রাট নবীর কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই শতাধিক সদস্যের বাহিনী রয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মাদক, অস্ত্র পাচার, অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িত এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও নতুন আতঙ্কের নাম নবী হোসেন গ্রুপ। তার বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক, অপহরণসহ এক ডজন মামলা রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তবে এখনো তাকে ধরা যায়নি, যা অনেকটা রহস্যের জন্ম দিয়েছে। কারণ এত নিরাপত্তার মধ্যে নবী হোসেনের নিয়মিত ইয়াবার চালান এ দেশে আনা অব্যাহত রয়েছে। এতে এলাকাবাসী হতবাক।
ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে এলাকাবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা সবকিছু জানি, কিন্তু মুখ খুলতে পারি না। কেউ তার বিরুদ্ধে কোনো তথ্য দিলে মৃত্যু নিশ্চিত। অপহরণ করে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। তার হাতে কত মানুষ যে মারা গেছে, এখনো মারা যাচ্ছে।’ গত সোমবার নাফ নদী থেকে দুই জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা নবীর হাতে খুন হয়েছেন বলে এলাকাবাসী জানান। এপার-ওপার দুই পারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকাও পান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঐ সদস্যরা। এ কারণে দুই পাড়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা পান নবী।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার বড় চালান পাচার করাই নবী হোসেনের প্রধান কাজ। সীমান্তের কাছাকাছি পাঁচটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার আসা-যাওয়া রয়েছে। সীমান্তের ওপারে চিংড়িঘের রয়েছে তার। এছাড়া আরো অনেক ব্যবসা আছে। ওপারেই বসবাস করেন। সীমান্তে মাদক পাচারের বড় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। সীমান্তে এখন বড় আতঙ্ক নবী হোসেন। উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে তার সিন্ডিকেট কাজ করে যাচ্ছে।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সীমান্তের কাছে নবী হোসেন গ্রুপের সঙ্গে বিজিবির গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বিজিবির টহল দলের ওপর নবী হোসেন গ্রুপ তিন শতাধিক গুলিবর্ষণ করে। বালুখালী সীমান্তের কাছে বসবাসরত আব্দুস সালাম জানান, সীমান্তের ওপারের চিংড়িঘের থেকে প্রায় সময় গুলির শব্দ এপারে ভেসে আসে। নদীপথে বেশির ভাগ মাদকের চালান নবী হোসেনের হাত ধরে বাংলাদেশে আসে। মিয়ানমারে অবস্থান করলেও মাদক বাংলাদেশে নিয়ে আসেন নবী। তার সহযোগীরা কেনাবেচা করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। একসময় আরএসওর কমান্ডার ছিলেন নবী।
উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্টে বসবাসকারী মোস্তাক আহমেদের ছেলে নবী হোসেন (৪৭) মিয়ানমারের মংডু ডেভুনিয়া তুমরা চাকমাপাড়ায় আরএসও কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। সেখানে প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্বে একটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে ২০১২ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে মাদ্রাসায় চাকরি নেন। ২০১৭ সালের আগস্টে তার পরিবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর নবী হোসেন কুতুপালংয়ে পরিবারের কাছে চলে আসেন। সে সময় তাকে দলে নিতে চাপ দেয় আরসা। এতে রাজি না হলে ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হয়। তখন মাদক চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। এরপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাহিনী গড়েন। ২০১৮ সালে মাদকের বড় চালান নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। এরপর থেকে ইয়াবার সব বড় চালান তার হাত ধরে দেশে আসছে। এখনো আরএসওর কিছু নেতার সঙ্গে নবীর যোগাযোগ রয়েছে। ওপারে তার প্রশিক্ষণ সেন্টার আছে।
নবী হোসেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সীমান্ত এলাকায় অপরাধের স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছেন। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, মিয়ানমার সীমান্তের শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী হোসেন গ্রুপের সদস্যরা সীমান্তে চোরাচালানসহ নানা অপরাধের সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
সবর্শেষ গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ধামনখালীতে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমার থেকে আসা দুজনকে বিজিবির টহল দল আটক করে তল্লাশি চালালে মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে সশস্ত্র নবী হোসেন গ্রুপ বিজিবিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। বিজিবিও আত্মরক্ষায় পালটা গুলি চালায়। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। শীর্ষসন্ত্রাসী ও মাদকসম্রাট রোহিঙ্গা নবী হোসেনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য দাবি জানিয়েছেন চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরী জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল হাজির বাড়ি এলাকায় সীমান্তে বিজিবিকে লক্ষ্য করে ইয়াবা কারবারিরা গুলিবর্ষণ করলে বিজিবি পালটা গুলি চালায়। তিনি আরো জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের (৩৪ বিজিবি) অধীন বালুখালী বিওপির দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে সীমান্ত পিলার-২০ থেকে প্রায় ৮০০ গজ উত্তর-পূর্ব কোণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইয়াবার চালান আসছে। এমন খবরে রহমতের বিল হাজির বাড়ি এলাকায় বালুখালী বিওপির একটি বিশেষ টহল দল অভিযান চালায়। বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা টহল দলকে লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করে। এ সময় বিজিবির সদস্যরা পালটা ফায়ার করেন। ইয়াবা কারবারিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে মিয়ানমারের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, রোহিঙ্গা নবী হোসেনের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেফতারে পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে।