খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। এখানে জমিতে সেচের জন্য একমাত্র ভরসা বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ। এছাড়া কতিপয় কৃষক নিজ উদ্যোগে বসিয়েছেন গভীর নলকূপ। তবে এই সংখ্যা হাতে গোনা। বিএমডিএ পরিচালিত এ গভীর নলকূপ অপারেটর (ডিপ অপারেটর) নিয়োগের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এসব নলকূপ অপারেটর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে নিয়োগ পান বলে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। নিয়োগ পেয়েই নলকূপ অপারেটররা নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে কৃষকদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। অতিরিক্ত টাকা না দিলে জমিতে সেচ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকেরা নলকূপ অপারেটরের হাতে ‘জিম্মি’ হয়ে পড়েছেন।
ভুক্তভোগী কৃষকদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, প্রতিটি গভীর নলকূপ অপারেটর নিয়োগ পেতে লাগে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। নিয়োগের পর অসহায় কৃষকদের কাছ থেকে সেই টাকা নানা কায়দায় আদায় করা হয়। সম্প্রতি সারের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। সুযোগ বুঝে সার ডিলাররাও কৃষকদের থেকে আদায় করছে অতিরিক্ত টাকা। এরপর জমিতে সেচ দিতে নলকূপ অপারেটরদের দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। তবে জমিতে সেচ বন্ধের ভয়ে ভুক্তভোগী কৃষকেরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদের সাহস পায় না। তবে গত বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহে গোদাগাড়ী উপজেলা নিমঘুটু গ্রামের অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি নামে দুই ‘আদিবাসী’ কৃষক বিএমডিএর ডিপ থেকে বোরোর জমিতে সেচের পানি না পেয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনার পরও পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি। বোরোর জমিতে সেচের পানি না পেয়ে এবারো গোদাগাড়ীর আরেক কৃষক মুকুল সরেন বিষপান করেন। তবে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। বিষয়টি তদন্ত করছে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি। সব মিলিয়ে নিজের জমিতে সরকারি ভর্তুকির সেচের পানি নিয়ে ফসল ফলাতে গিয়ে কৃষকদের জিম্মি দশা যেন কাটছেই না।
ভুক্তভোগী কৃষকদের দাবি, ‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, জমি তাদের (কৃষকদের)। কিন্তু অর্থের রাজত্ব ডিপ অপারেটরদের। যদিও কৃষকদের এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন অভিযুক্ত ডিপ অপারেটররা।’ তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়ন এলাকার ডিপ অপারেটর দুরুল হুদা দাবি করেন, ‘কৃষকরা বলে অনেক কথা। তাদের সব কথা সত্য নয়।’
বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, প্রকল্প এলাকায় (রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ) বিএমডিএর গভীর নলকূপ রয়েছে ১৫ হাজার ৩১৯টি। এসব নলকূপ স্থাপনের ফলে প্রকল্প এলাকায় ৪ লাখ ৯৬ হাজার ১৯৮ হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। বোরো আবাদ ছাড়াও আউশ ও রবি ফসলের জমিতেও এসব গভীর নলকূপ থেকে সেচ দেওয়া যায়। ফলে বৃষ্টি নির্ভর উঁচু জমিতেও ফসল আবাদের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র মতে, রাজশাহীর তানোর উপজেলায় বিএমডিএর গভীর নলকূপ সংখ্যা ৫৩৬টি। ব্যক্তি মালিকানায় গভীর নলকূপ রয়েছে ১৬টি। গভীর-অগভীর মিলিয়ে এই উপজেলায় মোট সেচপাম্প সংখ্যা ১ হাজার ৩৬৯টি। এই উপজেলায় আবাদযোগ্য কৃষি জমি ২৩ হাজার ৯৯৪ হেক্টর। এর মধ্যে সেচের আওতায় রয়েছে ২২ হাজার ৩৩২ হেক্টর।
তানোরের তালোন্দ ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের কৃষক মইফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ডিপ অপারেটরদের বক্তব্য সত্য নয়। বিএমডিএতে গভীর নলকূপের অপারেটর নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। যে দলের সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের নেতাদের নেতৃত্বে গভীর নলকূপ নিয়ে চলে বেপরোয়া বাণিজ্য। ডিপ অপারেটররা কৃষকদের বাধ্য করে তাদের জমি অপারেটরদের লিজ দিতে। নয়তো জমিতে সেচ বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ডিপ অপারেটররা জানেন, এটি লাভজনক পেশা। এ জন্য তারা টাকা দিয়ে হলেও এই পদে নিয়োগ নিয়ে থাকেন।
তানোরের কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, সরকার সেচে প্রচুর ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু ডিপ অপারেটরদের দুর্নীতির কারণে এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকেরা। কৃষকেরা অভিযোগ করেন, একটি গভীর নলকূপের আওতায় গড়ে ১০০ থেকে ৩০০ বিঘা জমি থাকে। এসব জমির মালিককে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় ডিপ অপারেটরের সঙ্গে। প্রতি বিঘা জমি লিজ হয় ১৪-১৫ হাজার টাকায়। অপারেটর এসব জমি নিজে লিজ নিয়ে জমির মালিককে দেন মাত্র ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা। প্রতিবাদ করলে ডিপ অপারেটর লিজ না নিয়ে মালিককে জমি চাষ করতে বলেন। আর কৃষক জমি চাষ করলে সেচে অপারেটর নানাভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে। টাকা না দিলে নানা কৌশলে জমির ফসল নষ্ট করা হয়। এর বাইরেও ট্রান্সফর্মার, মোটর বা ড্রেনের দোহাই দিয়েও কৃষকের নিকট থেকে আদায় করা হয় অতিরিক্ত টাকা।
এ বিষয়ে মতামতের জন্য বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, ‘গভীর নলকূপে প্রকারভেদে ঘণ্টাপ্রতি সেচের জন্য ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো অপারেটর সেচের জন্য কৃষকের নিকট থেকে বাড়তি টাকা নিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য কৃষকদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ সরকার সেচে ভর্তুকি দিচ্ছে। তাই কেউ অন্যায়ভাবে বেশি অর্থ নেবে, তা বরদাশত করা হবে না।