আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা। শুরু করেছেন ক্ষয়ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা। মোখার প্রভাবে একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে ২ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি, দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে ১ হাজার ২০০টির বেশি স্থাপনা। দ্বীপের মাঝেরপাড়া, কোনারপাড়া, গলাচিপা, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়ার অধিকাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের তিনটি ওয়ার্ডে প্রায় ২ হাজার বাড়িঘর। একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়া বাড়ির লোকজনের কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে এবং অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
এসব মানুষের জন্য অতিদ্রুত সহযোগিতা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন তারা। গতকাল সোমবার সকালে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে এসপি, প্রশাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তাগণ, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সেন্টমার্টিন দ্বীপে যান।
ঘূর্ণিঝড়ে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সদর, পৌর এলাকা, সাবরাং, ডেইলপাড়া, জাদিমুড়া, কোনারপাড়া ও গলাচিপা, বাহারছরা, হোয়াইক্যং, শাহপরীরদ্বীপ এলাকায় প্রচুর গাছপালা এবং ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে ঘরের চাল। ঝড় থামার পর এসব এলাকার মানুষ সড়ক থেকে গাছ সরিয়ে নিজেদের মাথাগোঁজার ঠাঁই ঠিক করার চেষ্টা করেন সোমবার সকাল হতে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম তীরের বাসিন্দা কবির আহমদ বলেন, ঝড়ে বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেছে। উপড়ে পড়েছে ঘেরা-বেড়াও। বৃষ্টির পানিতে রান্নাঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই চুলা জ্বলেনি, চাল-ডাল-তরকারি কিনতে পারলেও রান্না নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখায় প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে রবিবার দুপুর ২টা থেকে বিকাল সোয়া ৫টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় দ্বীপটির চরম ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা ও টিনের আধাপাকা ঘরবাড়ি ভাঙার পাশাপাশি উপড়ে গেছে পাঁচ শতাধিক নারকেলগাছসহ অন্তত কয়েক হাজার গাছগাছালি। ঝড়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১০-১২ জন। জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপটির উত্তরপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও পূর্ব দিকের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগে দ্বীপের তিনটি সাইক্লোন শেল্টার ও চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৩৭টি হোটেল-রিসোর্ট-কটেজে স্থানীয় প্রায় ৭ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে আনা হয়েছিল। যাদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থামার পর অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফিরে যান।
মোখার প্রভাবকে ১৯৯১ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে শক্তিশালী দাবি করে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, মোখা যখন দ্বীপ অতিক্রম করছিল, তখন সাগরে ভাটা ছিল। মরা কাটাল থাকায় জোয়ারের উচ্চতাও কম ছিল। ভরা কাটাল আর জোয়ার থাকলে ১৮০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার গতির মোখা ভিন্ন এক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারত।
চেয়ারম্যান মুজিব বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার সম্ভাব্য ভয়াবহতা নিয়ে শুরু থেকে প্রচারণা চালানোয় দ্বীপের বাসিন্দারা আতঙ্কে ছিলেন। ব্যাপক প্রচারণার ফলে দ্বীপের অধিবাসী প্রায় ৭ হাজার বাসিন্দা আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেন। গত কয়েক দশকের একাধিক ঘূর্ণিঝড়ে এত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠতে দেখিনি। আগেই নিরাপদে থাকায় তাণ্ডবে কারো প্রাণহানি ঘটেনি। চেয়ারম্যান মুজিব বলেন, রবিবার বেলা ২টা থেকে বিকাল সোয়া ৫টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে দ্বীপের ২ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৭০০ কাঁচা ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। হাজারো মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে ত্রাণসহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, সোমবার সকাল হতে লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামেন তিনি। ভেঙে পড়া গাছপালা সরিয়ে সড়ক চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। প্রতিটা ওয়ার্ডের সদস্যের নেতৃত্বে গৃহহীন পরিবারের সদস্যদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপে প্রায় পাঁচ শতাধিক নারকেলগাছ উপড়ে গেছে। দ্বীপে নারকেলগাছ ছিল প্রায় সাড়ে ৫ হাজার।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, নাফনদী ও সাগরের তীরবর্তী হওয়ায় আমার ইউনিয়ন শাহপরীরদ্বীপে তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় ২ হাজার বাড়িঘর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে মাথাগোঁজার ঠাঁই হারিয়ে চরম অসহায় জীবন কাটাচ্ছেন।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিন ও শাহপরীরদ্বীপ। এ দুই দ্বীপের প্রায় ২হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডিসি আরো বলেন, সেন্টমার্টিনের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের তালিকা তৈরি হচ্ছে। সোমবার সকালে সেন্টমার্টিন গিয়েছি আমরা। সেখানে অল্পপরিমাণ ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, বিজিবির সহযোগিতায় পর্যাপ্ত ত্রাণ ও গৃহনির্মাণসামগ্রী দ্বীপে নিয়ে বিতরণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
- তিন লবণচাষির মৃত্যু
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার হাত থেকে লবণ ও লবণ তৈরির সরঞ্জাম রক্ষা করতে গিয়ে মহেশখালীর তিন লবণচাষির মৃত্যু হয়েছে। উপকূলীয় লবণ মাঠে ঝড়ের কবল থেকে লবণ রক্ষার সময় অসুস্থ হয়ে তারা মারা গেছেন বলে উল্লেখ করেছেন মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর কাশেম চৌধুরী। মারা যাওয়া তিন লবণচাষি হলেন— উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজীরপাড়া গ্রামের আবুল ফজলের ছেলে রিদোয়ান (৩৫), পানির ছড়া গ্রামের আকতার কবিরের ছেলে মুহাম্মদ নেছার (৩২) ও পানির ছড়া বারোঘরপাড়ার মৃত মতনের ছেলে মোহাম্মদ আনছার। হোয়ানক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর কাশেম চৌধুরী স্থানীয়দের বরাত দিয়ে বলেন, গত রবিবার বেলা ১১টার দিকে মোখা ধীরে ধীরে শক্তি বাড়ালে পলিথিন ও লবণ সংরক্ষণে মাঠে যান ৪০-৫০ জন শ্রমিক। বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় কাজ করতে গিয়ে ঠান্ডায় অধিকাংশই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়।
মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, সকালে শ্রমিকরা মাঠে যাবার সময় কেউ খাবার নিয়ে যাননি। বেলা আড়াইটার দিকে দমকা বাতাস আর বৃষ্টির কবলে পড়ে ঠান্ডা লেগে তারা অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। দুজন অন্যদের অজান্তে অজ্ঞান হয়ে পানিতে পড়ে এবং একজন হাসপাতালে আনার পর মারা যান। সবার মৃত্যু ক্ষুধা ও ঠাণ্ডাজনিত কারণে হয়েছে বলে মনে হয়েছে।
- উখিয়া-টেকনাফে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি
টেকনাফ (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রায় আড়াই হাজার শেল্টার, তিন শতাধিক স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, ওয়াশরুম, সোলার প্যানেলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রবিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে এ ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন ক্যাম্প মাঝিরা। এ ক্ষতির পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর, রাস্তাঘাট মেরামত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। গতকাল সোমবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে কক্সবাজারে বিমান চলাচলও। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাঝি নুরুল আমিন বলেন, সিআইসি অফিস এবং বিভিন্ন এনজিওর পক্ষ থেকে আমাদেরকে সহযোগিতার জন্য তালিকা নিয়েছে।
- পুত্রসন্তানের নাম রাখা হলো ‘মোখা’
পেকুয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, কক্সবাজারের পেকুয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেওয়া পাঁচ প্রসূতি জন্ম দিয়েছে পাঁচ জন সন্তান। এদের মধ্যে এক প্রসূতি তার নবজাতকের নাম রেখেছেন ‘মোখা’। রবিবার ভোরে পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ শিশুর জন্ম হয়। প্রসূতির নাম জয়নব বেগম (১৯) । তিনি পেকুয়া উপজেলার দুর্গম রাজাখালী ইউনিয়নের বামুলাপাড়ার মো. আরকানের স্ত্রী।