চট্টগ্রাম নগরীতে পানি, গ্যাস ও টেলিফোন লাইন কোনোটিই সুনির্দিষ্ট প্ল্যানের আওতায় হয়নি। নিজেদের মতো করে স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বাসাবাড়িতে ইচ্ছামতো সেপটিক ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। অধিকাংশ সেপটিক ট্যাংক নিয়ম মেনে করা হয়নি। আবাসিক ভবনে চলছে গার্মেন্টস কারখানা ও নানা ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এসবের কারণে বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, সেবা প্রতিষ্ঠানের সংযোগ আর বিল্ডিং নির্মাণের জন্য সিডিএর অনুমোদন দেওয়ার পর পরবর্তী সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনিটরিং করছে না। মনিটরিং না করায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
দীর্ঘ সময়েও চট্টগ্রামে সেন্ট্রাল পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। সম্প্রতি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ একটি পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। ফলে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় নগরবাসী নিজ বাসাবাড়িতে সেপটিক ট্যাংক নির্মাণ করেছে। কিন্তু বাসাবাড়িতে নির্মিত এসব সেপটিক ট্যাংক যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে মাঝে মধ্যে সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাকলিয়া বলির হাট এলাকায় সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে দেখা গেছে, সেপটিক ট্যাংকের পাইপলাইন ও প্রাকৃতিক গ্যাসের লাইন পাশাপাশি রয়েছে। লাইনের গ্যাস লিকেজ হয়ে মিশ্রণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রাকৃতিক গ্যাসলাইনের ছিদ্র থেকে পয়োনিষ্কাশন লাইনে মিথেন গ্যাস জমা হলে বিস্ফোরণ ঘটে। অধিকাংশ সেপটিক ট্যাংকে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকে না। দীর্ঘ সময় জমে থাকায় ট্যাংকিতে চাপ বেড়ে যায়। একটি সেপটিক ট্যাংকিতে তিনটি চেম্বার থাকতে হয়। না হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। বদ্ধ জায়গায় গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্তে গ্যাসের সেন্সর অ্যালার্মের ব্যবস্থা থাকতে হবে। চুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম ইত্তেফাককে বলেন, ‘সেপটিক ট্যাংকে তিন ধরনের চেম্বার থাকতে হয়। কিন্তু কোনো নিয়ম মেনে সেপটিক ট্যাংক করা হচ্ছে না। পানির লাইন, গ্যাসলাইন কোনোটি মাস্টার প্ল্যানের আলোকে নির্মিত হয়নি। মনিটরিং হচ্ছে না।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সেপটিক ট্যাংক এক বছর পর পর পরিষ্কার করতে হয়। পরিষ্কার করলে গ্যাস জমার সম্ভাবনা থাকে না। নগরীর বাসাবাড়ির ৮৪ শতাংশ সেপটিক ট্যাংকই ড্রেনের সঙ্গে যুক্ত। এগুলো পরিষ্কার করার স্বাস্থ্যসম্মত কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি।’
নগরীতে ১৯৮৪ সালে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। তখন অনেক বিতরণ লাইন করা হয়েছে। কিন্তু লাইনগুলো পুরোনো হয়ে গেছে। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির আওতায় প্রায় দেড় লাখ গ্যাস রাইজার রয়েছে। গ্যাস রাইজারগুলো খোলা জায়গায় বসাতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ গ্যাস রাইজার আবদ্ধ জায়গায় বসানো হয়েছে। এতে রাইজার লিকেজ হলে গ্যাস বের হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। তবে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস) প্রকৌশলী মু. রইস উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রকল্পের আওতায় শহরের অধিকাংশ রাইজার পরীক্ষা করা হয়েছিল। লিকেজগুলো মেরামত করা হয়েছে।
সিডিএ জানায়, তাদের কাজ হচ্ছে প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া ও প্ল্যান অনুসারে স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে কিনা মনিটরিং করা। কিন্তু জনবল সংকটসহ নানা কারণে সেই কাজটি সিডিএ যথাযথভাবে করতে পারছে না। ফলে প্ল্যানবহির্ভূত স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার দায়িত্ব গণপূর্ত বিভাগের। পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে সিটি করপোরেশন। প্রায় এক বছর আগে নকশাবহির্ভূত ৫ হাজার ভবন চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের বর্ধিত অংশ ভেঙে ফেলতে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ স্থাপনার মালিক সিডিএর নির্দেশ অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
জানতে চাইলে সিডিএর সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘সেবা সংস্থাগুলোর অনুমোদন-পরবর্তী মনিটরিং কাজ হচ্ছে না। এতে মাঠ পর্যায়ে অনিয়ম বেড়ে যাচ্ছে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। পয়োনিষ্কাশন লাইন ও গ্যাসলাইনের অবস্থান আলাদা থাকতে হবে। জনবলের সংকট থাকলে নিয়োগ দিয়ে মনিটরিং কার্যক্রম চালু রাখতে হবে।’
এদিকে সিডিএর আবাসিক এলাকাগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ছেয়ে গেছে। ভবনের মালিকরা এনজিও, বাণিজ্যিক গুদাম, বেসরকারি ক্লিনিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ভাড়া দিচ্ছে। অনেকে কারখানার কাজেও ব্যবহার করছে। কিন্তু সিডিএ এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।