আগে সিএমসি (কম্প্রিহেনসিভ মেন্টেইন্যান্স কন্ট্রাক্ট) করতে হবে এরপর মেরামত কাজ করা হবে—ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এমন শর্তের মধ্যে এক বছর যাবত্ সেবা বন্ধ রয়েছে চমেক হাসপাতালের এমআরআই মেশিনের। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। জনগুরুত্বপূর্ণ মেশিনটি মেরামতের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক বছর যাবত্ মন্ত্রণালয়ে একের পর এক চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্বাসের মধ্যেই পার হয়ে গেছে একটি বছর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিএমসি করতে হলে মাসে ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। এক বছরের জন্য সিএমসি করতে হবে। এই নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। হাসপাতালে একই সঙ্গে নারীদের জরায়ু চিকিত্সার ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটিও অচল অবস্থায় পড়ে আছে।
চিকিৎসকরা জানান, প্রতিদিন চমেক হাসপাতালে এমআরআই করানোর জন্য অসংখ্য রোগী ভিড় করছেন। পরে যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছেন। প্রায় ১০ কোটি টাকায় কেনা চমেক হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটির ওয়ারেন্টির মেয়াদ ছিল তিন বছর। অথচ বেসরকারি হাসপাতালে ক্রয় করা এধরনের মেশিনের ওয়ারেন্টির মেয়াদ ১০/১২ বছর হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্টদের এধরনের দুর্বল চুক্তির সুযোগ নিচ্ছে ঠিকাদার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমআরআই ও ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনের বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখছে। এখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো করণীয় নেই। দুটি মেশিনের বিষয়ে এক বছর যাবৎ কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন।
চিকিৎসকরা জানান, দীর্ঘদিন যাবত্ মূল্যবান মেশিনগুলো অচল পড়ে থাকায় সেগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পরবর্তীকালে মেশিনের স্থায়িত্ব নিয়ে সমস্যা হতে পারে।
২০১৬ সালে ১২ লাখ ৩০ হাজার ডলার বা ৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকায় এমআরআই মেশিনটি ক্রয় করা হয়। গত ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট রেডিওলজি বিভাগে এমআরআই মেশিনটি বসানো হয়। মেশিনটির ওয়ারেন্টির মেয়াদ ছিল তিন বছর। গত ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেশিনটি মেরামতের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেডকে জানালে তারা মেরামতের জন্য ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা চাহিদাপত্র প্রেরণ করে। পরে মেডিটেল কোম্পানি মেশিনটি মেরামত করে। ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নিরবচ্ছিন্ন সেবা পেতে সিএমসি করার জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দ্বিতীয়বার চিঠি দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ৯ মার্চ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এক বছরের সিএমসি বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার ডলার দাবি করে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, আগে এক বছরের জন্য সিএমসি করতে হবে। তখন তারা মেরামতের উদ্যোগ নেবে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সিএমসি করতে গেলে প্রতি মাসে ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে একটি এমআরআই করতে রোগী কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা ফি নেওয়া হয়। ফলে এত টাকায় সিএমসি করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শামীম আহসান বলেন, ‘মেশিনগুলোর মেরামত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রায়ই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হচ্ছে। সিএমসি নিয়ে জটিলতায় মেরামত কাজ আটকে রয়েছে।’
রেডিওথেরাপি বিভাগের ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি গত বছরের ১৪ জুন থেকে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এটি দিয়ে নারীদের জরায়ুর ক্যানসারে চিকিত্সা দেওয়া হয়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব প্রকৌশলীরা মেশিনটি চালুর চেষ্টা করলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের সরবরাহ না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি অবহিত করা হলে জবাবে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, জার্মানি থেকে এক সঙ্গে পাঁচটি মেশিন ক্রয় করা হয়েছিল। তার মধ্যে তিনটি মেশিনের ৩০ শতাংশ টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। বাকি টাকা পরিশোধ করা না হলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেশিনগুলোর ওয়ারেন্টি সার্ভিস প্রদান ও মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। ফলে মেশিনটি এখন অচল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন নেই। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা। সরকারি হাসপাতালে এক থেরাপি দিতে দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। পরপর তিন বার থেরাপি দিতে হয়। বেসরকারিতে খরচ কয়েক গুণ বেশি।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে এমআরআই মেশিনটি গত দেড় বছর যাবত্ নষ্ট অবস্থায় পড়ে রয়েছে। গত ২০১৫ সালে এমআরআই মেশিনটি বসানো হয়েছে। কিন্তু মেশিনটি কেনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে আদালতে মামলা চলছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, মেশিনটি ক্রয় সংক্রান্ত নিয়ে মামলা থাকায় মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না।