নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৭ জুলাই মেয়াদোত্তীর্ণ আটটি পৌরসভায় ভোট গ্রহণের কথা রয়েছে। তবে একটি পৌরসভায় চলছে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীর দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের যজ্ঞ। ইতোমধ্যে দশ নেতা-কর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছে। আগের মামলায় জামিন পেলেও তারা যেন ভোটের আগে মুক্ত হতে না পারেন, সেলক্ষ্যে দেওয়া হচ্ছে নতুন-নতুন মামলা। অন্য নেতা-কর্মীদেরও জড়ানো হচ্ছে এসব মামলায়।
জানা গেছে, এসব মামলার নেপথ্যে প্রধান ভূমিকায় থাকা স্থানীয় এক ‘নেতা’ নাকি ঘোষণা করেছেন- ভোটের আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী ঐ মেয়র প্রার্থীকে কর্মীশূন্য করা হবে। যাতে ভোটেরদিন কেন্দ্রে-কেন্দ্রে এজেন্ট দেওয়ার মত কর্মীও না থাকে। কথিত ঐ নেতা এলাকায় হুমকি-ধামকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন যে, কয়টি মামলায় জামিন পাবে, একটার পর একটা মামলা দেওয়া হবে।
আইন অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সমপ্রতি দেশের আটটি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইসিকে অনুরোধ জানায়। সেই অনুযায়ী ইসি নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়ে গত ৩১ মে তফসিল ঘোষণা করে। আইন অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর থেকে স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকার কথা। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট ঐ পৌরসভায় চলমান ঘটনাবলীতে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কি-না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় ভোটাররা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপর্যপুরি এসব হয়রানিমূলক মামলার প্রথম ধাপে টার্গেট করা হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী ঐ মেয়র প্রার্থীর মূল দলের এবং দলটির অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনসমূহের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের। দলীয় মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনি প্রচারণায় যারা মূল ভূমিকা রাখবেন, এরকম ১০ নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অথচ, এবারের রমজানে একটি ইফতার পার্টিতে যোগদান শেষে ফেরার পথে যারা ভুক্তভোগী দলটির নেতাকর্মীদের উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল এবং কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করেছিল, হামলার নেপথ্যকারীরাই উল্টো মামলা দিয়ে তাদেরকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ভুক্তভোগী দলটির নেতাকর্মীদের উপর সশস্ত্র হামলা ও তাদেরকে বহনকারী যানবাহন ভাংচুরকারীদের হুকুমদাতারা নিজেদের স্থানীয় একটি কার্যালয়ে চেয়ার ভাংচুর করে। আক্রমণের শিকারদের মামলায় ফাঁসাতে তারা নিজেরাই নিজেদের কার্যালয়ে কথিত ঐ হামলা চালিয়েছিল। যারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১০ জন উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান। তবে, উচ্চ আদালতের জামিনের মেয়াদান্তে কয়দিন আগে তারা স্থানীয় নিম্ন আদালতে গেলে তাদেরকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অথচ, একই মামলায় ২০-২২ জনকে আসামি করা হলেও তাদের প্রায় অর্ধসংখ্যক নেতা-কর্মী ওই আদালত থেকেই জামিন পেয়েছিলেন।
সংসদকার্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আনিসুল হক (আইনমন্ত্রী) গত ৮ জুন এক প্রশ্নের জবাবে সংসদকে জানিয়েছিলেন, ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজন করাকে নির্বাচন কমিশন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। সরকারের কোনো সংস্থা কর্তৃক কোনো ধরনের হয়রানিমূলক মামলা না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ কিন্তু, আইনসভাকে জানানো আইনমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ঐ পৌরসভায়। সংবিধান মতে, সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ছয় থেকে সাড়ে ছয় মাসের মতো বাকি থাকলেও এখনই হয়রানিমূলক ও নানা অবান্তর অভিযোগে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীর দলীয় নেতা-কর্মীদের মামলার জালে আটকানো হচ্ছে।
এই মামলার জাল সৃজনকারীরাই সমপ্রতি সংশ্লিষ্ট এলাকায় একটি সভায় প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা নৌকা দিছে, আবার ইলেকশন কিসের? কিসের ইলেকশন? আর ইলেকশন যদি হয়, বুঝে নেবেন ইলেকশন কাহাকে বলে।’
জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের গত ৩ জুন নরসিংদীতে একটি দলীয় অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দেশে একটি দল আছে; বিচারবিভাগ, প্রশাসন, ইসি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সবাই ওই দলের সদস্য। তাদের সবাইকে সেই দলই রক্ষা করছে। তাহলে নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হবে?’ সংশ্লিষ্ট পৌরসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান ঘটনাপ্রবাহ যেন জিএম কাদেরের সেই বক্তব্যেরই বাস্তবরূপ।