লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বছরের প্রথম দিন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হয়ে আবারও ফিরে আসেন। এর ফলে অবসান ঘটে দেশটির এক দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াইয়ের। দা সিলভা ও বিদায়ি প্রেসিডেন্ট জাইর বলসেনারোর মধ্যে অক্টোবরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি ছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ। নির্বাচনটি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এজন্য নয় ব্রাজিল লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম দেশ, আমাজনের চিরহরিৎ বন সেখানে রয়েছে। বরং রাজনৈতিক কারণে তীব্র ডানপন্থি বলসেনারোর বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। অপরদিকে দা সিলভা প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ার পর মামলা মোকদ্দমায় জেলও খেটেছেন। তিনি আবারও সেই পদে ফিরতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল কৌতূহল।
এর কয়েক মাস আগে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাত্রঁদ্ধ প্রতিদ্বন্দ্বী ডান চরমপন্থি মেরি লিপেনকে অল্প ব্যবধানে হারান। হাঙ্গেরিতে পপুলিস্ট প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান ক্ষমতা ধরে রাখতে বিরোধীদের সঙ্গে কোয়ালিশন করতে সক্ষম হয়েছেন। ফিলিপাইনে দীর্ঘ তিন দশক পর গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত মার্কোসের ছেলে বংবং মার্কোস বিশাল ব্যবধানে জিতেছেন। লক্ষণীয়, সবগুলো ক্ষেত্রেই চরম ডানপন্থিরা হেরে গেছে। ২০২২ সালের মতো ২০২৩ সালেও কয়েকটি দেশের নির্বাচন এবার আন্তর্জাতিক কৌতূহলের কেন্দ্রে থাকবে। গত বছর বেশির ভাগ ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, এ বছর নির্বাচনের বেশির ভাগ পার্লামেন্ট নির্বাচন। কেবল নাইজেরিয়া ও গুয়াতেমালায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে।
চলতি বছর যেসব দেশে নির্বাচনের দিকে সবার নজর থাকবে তাদের মধ্যে আছে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, কঙ্গো, আর্জেন্টিনা ও স্পেন। এই দেশগুলোসহ মোট ১৩টি দেশে এ বছর প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে। তুরস্ক ও নিউজিল্যান্ডে জাতিগত সংখ্যালঘু কুর্দি ও মাউরিদের প্রতিনিধিত্ব করা দলগুলো কিংমেকারের ভূমিকায় আসতে পারে। ফিনল্যান্ডে আদিবাসী সামি গোষ্ঠীকেও এ পর্যায়ে রাখা যেতে পারে। আর্জেন্টিনা ও পাকিস্তান উভয়কে কঠিন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। উভয় দেশেই বিরোধী দলের ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। গুয়াতেমালা, তুরস্ক ও পোল্যান্ডে ক্ষমতাসীনরা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কেবল নাইজেরিয়া ও কঙ্গোতে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর ঘটবে বলে আশা করা যায়।
ইউক্রেন রাশিয়া গত প্রায় এক বছর ধরে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তার কমবেশি প্রভাব চলতি বছর অনুষ্ঠেয় প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে থাকবে বলে ধরেই নেওয়া যায়। রুশ সীমান্তবর্তী ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়া মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। অপরদিকে এই যুদ্ধে ন্যাটোর অন্যতম ফ্রন্টলাইন পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীনরা পশ্চিমাদের সুনজরে থাকাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। যদিও এর ফলে দেশটিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তুরস্ক ও স্পেনও প্রায় একই পথ অনুসরণ করছে। যুদ্ধ না হলে ইউক্রেনে এ বছর পার্লামেন্ট নির্বাচন হতো। যুদ্ধের কারণে দেশটিতে সামরিক আইন ও জরুরি অবস্থা জারি করা আছে। এর মধ্যে সেখানে নির্বাচন হবে কি না, তা একেবারেই অনিশ্চিত। অতিসম্প্রতি রাশিয়া সেখানে যেভাবে হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে সেটা ইউক্রেনকে আরো কোনঠাসা করে ফেলতে পারে। কয়েকটি দেশের পরিস্থিতি এখানে আলোচনা করা যাক।
নাইজেরিয়া আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। কিন্তু ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের বয়স নিচে ৬০ বছর। এছাড়া পার্লামেন্টে নারীর প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে ক্ষমতাসীন মধ্য-বামপন্থি অল প্রগ্রেসিভ কংগ্রেসের (এপিসি) মুহাম্মাদু বুহারির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সোশ্যালিস্ট লেবার পার্টির পিটার অবি। বুহারির বয়স ৮০ এবং অবির ৬০। এছাড়া আরেক জন প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন ৭৬ বছর বয়সি পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির আতিকু আবুবাকর। ক্ষমতায় যে পরিবর্তনই আসুক, এতে তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না। তবে অবি তুলনামূলকভাবে তরুণদের পছন্দের একজন প্রার্থী।
রাশিয়ার সীমান্ত লাগোয়া দেশগুলোর দুটো হলো ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়া। উভয় দেশই ইইউর সদস্য। উভয় দেশই তুলনামূলক তরুণ বয়সি নারী শাসিত। এর মধ্যে ফিনল্যান্ডের অবস্থানটি গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার ৮৩০ মাইল সীমান্ত রয়েছে। দেশটির ৩৪ বছর বয়সি প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার একটি প্রটোকলে সই করেছেন। যদিও দেশটি ন্যাটোর সদস্য নয়, কিন্তু প্রটোকল সই করার মাধ্যমে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কেও ক্ষেত্রে তিনি একটি বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। ২ এপ্রিল সেখানে পার্লামেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
থাইল্যান্ডে আনুষ্ঠানিক রাজতন্ত্র ও পাশাপাশি সময় সময় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা দেখা যায়। সময় সময় বললাম এজন্য, দেশটিতে প্রায়শই সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। সর্বশেষ ২০১৪ সাল থেকে সেখানে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আছে। ৭ মে সেখানে পার্লামেন্ট নির্বাচন। জান্তা প্রধান প্রায়ুথ চান ওচা খুবই অজনপ্রিয়। কারণ বিরোধীদের ওপর ধরপাকড় ও দমনাভিযান। এছাড়া কোভিড নিয়ন্ত্রণেও তিনি সফলতার পরিচয় দিতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। মের নির্বাচনে মুখ ফরোয়ার্ড পার্টি ও ফিউচার ফরোয়ার্ড এগিয়ে আছে। জান্তা ইতিমধ্যেই ২৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করে নিয়েছে। নির্বাচনে ক্ষমতায় যারাই আসুক তাদের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ হবে না বলেই মনে হয়।
তুরস্কে ১৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান সম্ভবত শেষ বারের মতো এতে প্রার্থী হচ্ছেন। ২০০২ সালে তিনি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হন। তুরস্কে তখন পার্লামেন্টারি সরকার ব্যবস্থা ছিল। ২০০৭ এ তিনি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি চালুর জন্য গণভোট দেন। ২০১৪ সালে তিনি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট হন। গত দুই দশকে তিনি বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন, যার অনেকগুলো নিয়েই রয়েছে বিতর্ক। ২০১৬ সালে তার বিরুদ্ধে হওয়া সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। এরপর থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। তিনি দেশকে সেকুলার পরিচয় থেকে বের করে এনেছেন। একনায়কসুলভ ইমেজ সত্ত্বেও পশ্চিমের কাছে তুরস্কের তিনি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটিকে নতুন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় এনেছে। বিষয়টি নির্বাচনে এরদোয়ানকে এগিয়ে রাখবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
পাকিস্তানে অক্টোবরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। গত বছর ৯ এপ্রিল অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের কোয়ালিশন সরকারের গতন ঘটে। এরপর প্রায় পুরোটা সময় রাজনীতির অঙ্গন তিনি সরগরম রেখেছেন। এছাড়া গত বছর এক প্রলঙ্করী বন্যা মোকাবিলা করতে হয় দেশটিকে। সব মিলিয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে পাকিস্তান। ২০১৮ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক ই ইনসাফ পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ঋণসংকটের কারণে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সংকট পোহাতে হয়েছে। ইমরানের সময় আইএমএফ কোনো ঋণ ছাড় করেনি। এবারের নির্বাচনে ইমরান খান অংশ নিতে পারবেন কি না, সেটি নিশ্চিত নয়। কারণ শাহবাজ শরীফের সরকার এ বিষয়ে তার ওপর নানা আইনি প্রতিবন্ধকতা আরোপ করেছে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে টিটিপিই পুনরায় ক্ষমতায় আসবে বলে ব্যাপক ধারণা করা হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তবে পদটির প্রতীকী গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুব প্রথম নারী ও মুসলিম হিসেবে ঐ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এছাড়া তার আরেকটি পরিচয় তিনি জাতিগত মালয়। দেশটিতে গত ছয় দশকের ইতিহাসে কোনো মালয় ঐ পদে আসীন হননি। সিঙ্গাপুরের জনগোষ্ঠী মূলত জাতিগত চীনা, ভারতীয় ও মালয়ে বিভক্ত। ক্ষমতার চাকা মূলত ভারতীয় ও চীনাদের কাছেই রয়ে গেছে। সিঙ্গাপুর তুলনামূলক দুর্নীতিমুক্ত হলেও জনগণ পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করে না। স্বাধীনতার পর থেকে এক পরিবার দিয়েই দেশটি শাসিত হয়ে এসেছে। মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা।
গত বছর কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আর্জেন্টিনা এখন ক্রীড়ামোদি বিশ্বের নজরে। লাতিন আমেরিকার এই দেশটিও দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক সংকটে। মুদ্রাস্ফীতির রাশও টেনে ধরা যাচ্ছে না। এর মধ্যে হানা দিয়েছে করোনা ভাইরাস। বর্তমানে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির হার বিশ্বে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ বা তারচেয়ে বেশি। ২৯ অক্টোবর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে ক্ষমতাসীন আলবার্তো ফার্নান্দেজের সঙ্গে কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছেন ফ্রেন্টে ডে টোডোস।