টাকার বিনিময়ে এবং ব্যক্তি বিশেষের বলয় সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজাকার-আল বদর-আল শাম্সসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের সন্তানদেরকে সংগঠনে অনুপ্রবেশ করানোর খেসারত দিচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগ। ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে খোলস পাল্টে স্বাধীনতাবিরোধীদের পোষ্যদের যারা বিভিন্ন সময়ে, এর-ওর হাত ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে অনুপ্রবেশ করেছেন- তারা জড়িয়ে পড়েছেন নানা অপকর্মে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ এমন কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নেই- যা তারা করছেন না। এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এরা রীতিমত ‘টর্চার সেল’ বানিয়েছে। যেখানে যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখে নিষ্ঠুরভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানোর ঘটনাও ঘটছে।
কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ছাত্রাবাসে চারজনকে রাতভর পিটিয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে পাঠানো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক শিক্ষার্থীকে কক্ষে আটকে মারধর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) যুবককে অচেতন করে অর্থ আত্মসাৎ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে চাঁদা আদায়, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে পিটিয়ে স্বর্ণালংকার ছিনতাই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় কাভার্ড ভ্যান আটকে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মীর টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন দেশজুড়ে আলোচনায়।
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন নেতা আলাপকালে ইত্তেফাককে বলেন, ‘ছাত্রলীগ হওয়া যায় না। ছাত্রলীগ রক্তে থাকতে হয়। বংশ পরম্পরায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যারা অতীতে এসেছেন কিংবা বর্তমানে রয়েছেন- তারা কখনও এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারেন না। রাজাকার-আল বদর-আল শাম্সসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের সন্তানদের মধ্যে যারা অর্থের বিনিময়ে এবং ছলে-বলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে অনুপ্রবেশ করেছেন, তারাই এসব ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িত।’ তারা আক্ষেপ করে বলেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের কুকর্মের কারণে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ছাত্রলীগ। অথচ এই ছাত্রলীগ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রসৈনিক ছিল।’
শুধু ছাত্রলীগেই নয়; ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্তরের কমিটিতেও গত ১৩ বছরে অনুপ্রবেশ করেছে স্বাধীনতা-বিরোধীদের পোষ্যরা। আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশই নয়, বিপুল অর্থের বিনিময়ে এরা বাগিয়ে নিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিও। এই ‘হাইব্রিড আওয়ামী লীগ’ নেতারা গত ১৩ বছরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ-বৈভবেরও মালিক বনেছেন। আর এই অর্থের একাংশ দিয়ে এরা কব্জায় নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকেও। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন কোনো স্তর নেই, যেখানে তাদের হাত পৌঁছায়নি। যার কারণে, এরা লুটপাট-দুর্নীতি-অপরাধ চালাচ্ছে নির্বিঘ্নে।
রাজনীতির নামে এমন লুটপাটের কথা বলতে গিয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের মঙ্গলবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ও আমলাতন্ত্রের যোগসাজসে কিছু নামধারী ব্যবসায়ী লুটপাট করে দেশকে শেষ করে দিচ্ছে। বাস্তবে এদের কোনো ব্যবসা নেই, অথচ তারা হাজার-কোটি টাকা আয় করছে। এই লুটেরাদের কাউকে-কাউকে আবার এমপি-মন্ত্রীও বানানো হয়। বড় বড় লুটেরারা বড় দেশপ্রেমিক সেজে গলায় মালা নিয়ে ঘুরছে।’
ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভয়ঙ্কর নির্যাতকের তালিকায় আছেন ছাত্রীরাও। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ছাত্রী হলে রবিবার রাতে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে আটকে রেখে এবং বিবস্ত্র করে সাড়ে চার ঘণ্টা অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এই নির্যাতনের নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা। ঘটনার শিকার ছাত্রীটি নির্যাতনের যেই ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে বিবেচক যে কারোই গা শিউরে উঠবে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গণমাধ্যমের কাছে ছাত্রীটি বলেছেন, ‘ওরা কয়েকজন মিলে সারা শরীরে লাথি মেরেছে, চড়-থাপ্পড় মেরেছে, বুকে সজোরে থাপ্পড় মেরেছে, হাত-পায়ের তালুতে সুই ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ এক পর্যায়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে নির্যাতকেরা। বাইরে ঘটনা কাউকে জানালে সেই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলেও নির্যাতকেরা হুমকি দিয়ে রাখে ভুক্তভোগীকে।
এই ঘটনার মাত্র চারদিন আগে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) প্রধান ছাত্রাবাসে চার শিক্ষার্থীকে কথিত ‘টর্চার সেলে’ আটকে রাতভর পিটিয়ে আইসিইউতে পাঠিয়েছে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মী। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা লিখিত অভিযোগে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, ‘কক্ষে আটকে রেখে তাদেরকে স্টাম্প, রড ও প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে রাতভর পেটানো হয়। নিশ্বাস বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত নাকে-মুখে পানি ঢালা হয়েছে। সঙ্গে চলেছে কিল-ঘুসি-লাথি-চড়-চাপ্প্ড়।’ কাউকে ঘটনা জানালে হাসপাতাল থেকে মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলেও শাসায় নির্যাতক চক্রটি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের এক ছাত্রকে রবিবার রাতে হলের একটি কক্ষে আটকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে হল শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। নির্যাতনের পাশাপাশি ওই শিক্ষার্থীকে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য, ছিনতাই-মারধর-হেনস্তা-চাঁদাবাজিসহ নানা নেতিবাচক ঘটনায় যুক্ত থাকায় ঢাবি, জাবি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), রুয়েট এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ২১ নেতা-কর্মীকে রবিবার সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এছাড়া চাঁদার জন্য হুমকি ও ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত থাকায় এক নেতাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগ।
গত ৩০ জানুয়ারি চাঁদার জন্য তলব করার পর যেতে রাজি না হওয়ায় প্রথমে ফোনে হুমকি ও পরদিন লোক পাঠিয়ে রাজধানীর বঙ্গবাজারের এক পানি ব্যবসায়ীর মালামাল ভাঙচুর করানোর অভিযোগ ওঠে ঢাবির অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হাসান ওরফে সোহাগের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।
গত ১৫ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক দম্পতিকে মারধর ও হেনস্তা করে স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের অভিযোগে করা মামলায় দুইদিন পর গ্রেফতার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হল শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজির আরাফাত ওরফে তুষার । তবে একদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে আবার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। একই মামলার আরেক আসামি ছিলেন জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী রাহুল রায়। এ ঘটনায় দুজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ।
বহিষ্কৃতদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাবির সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ফাহিম তাজওয়ার ওরফে জয় ও সাজিদ আহমেদ। ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় মাস্টারদা সূর্য সেন হলের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল মোতালেব ও তার পরিবারের সদস্যদের মারধর এবং ছিনতাইয়ের ঘটনায় হওয়া মামলার আসামি তারা।
৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাভার্ড ভ্যান আটকে টাকা ছিনতাই ও চালককে মারধরের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসংলগ্ন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) মসজিদের সামনে থেকে গ্রেফতার হন ঢাবির বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ফজলে নাভিদ ওরফে সাকিল, সাদিক আহাম্মদ ও মো. রাহাত রহমান। ওই ঘটনায় হওয়া মামলায় তিনজনই এখন কারাগারে।
৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা এক শিক্ষার্থীকে অপহরণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগে করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন রুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক শাহ আলম ওরফে রাতুল, কর্মী নূর মোহাম্মদ ওরফে নাবিল ও কামরান সিদ্দিক ওরফে রাশেদ।
৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের সামনের সড়কে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় দুটি রিকশা ভেঙে যায়। এর মধ্যে একটি রিকশার চালকের পা ভেঙে যায়। ঘটনা দেখে প্রাইভেট কারটি আটকে চালককে মারধর করেন শহীদুল্লাহ্ হল শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। একপর্যায়ে তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়। পরদিন প্রাইভেট কারটির চালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক উপসম্পাদক নাজমুল হাসান ওরফে রুপু ও ফজলুল হক হল শাখার কর্মী মো. তারেকসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
৮ ফেব্রুয়ারি রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলে এক যুবককে অচেতন করে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক অসিত পালের বিরুদ্ধে। ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে বাধা দেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক উপগ্রুপ ভিএক্স ও বাংলার মুখের অনুসারীরা। ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় ক্যাম্পাসে কর্মরত এক নারী সাংবাদিককে হেনস্তা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এসময় উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন তারা। ওই ঘটনায় জড়িত নেতা-কর্মীদের অন্যতম ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারুফ ইসলাম।
এছাড়া ৯ ফেব্রুয়ারি সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ শাখার সাবেক সহসম্পাদক রাকিবুল ইসলাম ওরফে রাকিব এক নারী নেত্রীকে মারধর ও শ্লীলতাহানি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ওই নেত্রী সূত্রাপুর থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এসব ঘটনা ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন। ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কারও কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।’