জার্মানির নতুন পাঠ ও ইউরোপের বাস্তবতা


ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের বিপরীতে বর্তমান অবকাঠামোতে আসার আগেই জার্মানি তার সাম্রাজ্য ত্যাগ করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের দানবতা এবং জার্মানির অন্যান্য নৃশংসতা দেশটির জনসাধারণের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। বর্তমানে জার্মানি ক্রমবর্ধমানভাবে বহুজাতিক রাষ্ট্র হয়ে উঠছে। ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, জার্মানির বাসিন্দাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী

গত জুনে যখন জার্মান সরকার দেশের প্রথম জাতীয় নিরাপত্তাকৌশল নির্ধারণ করে, তখন সেখানে বেশ কিছু তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেকেরই এটা মনে হয়েছে যে, জার্মানি একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধোত্তর সময়ে জার্মানি প্রথম বারের মতো বাকি বিশ্বের দিকে যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে। এ বিষয়ে বলতে হয় চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজের ভূমিকার কথা। তিনি জার্মানিকে তার স্বাভাবিক ইউরোপীয় সীমানার বাইরে বিশেষ ভূমিকায় দেখতে চান বলে মনে হয়েছে। উল্লেখ করতেই হয়, কয়েক দশক ধরে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য জার্মানির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে নতুন বাস্তবতা হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের সূচনা জার্মানিকে তার কমফোর্ট জোনের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এটা জার্মানির জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।

আমরা দেখেছি, জার্মানি যখন পশ্চিমের বাইরে উদ্যোগী হয়েছে, তখন তার ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস এবং অন্যান্য জাতির সঙ্গে অতীত সম্পর্ক বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি হতে হচ্ছে জার্মানিকে। বলা যায়, এটি তাকে তার আত্মবোধের আয়নার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। জার্মানির মতো একটি দেশের যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব রয়েছে এবং এই দেশটি যখন তার সংবেদনশীল সংস্কৃতির জন্য গভীরভাবে গর্ব অনুভব করে, তখন তার জন্য এটি কোনো সহজ কাজ নয়।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ জার্মানির কিছু অতীত ক্ষতকে তীব্রভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। অনেকের মনেই এই প্রশ্ন ছিল যে, রাশিয়া কি সোভিয়েত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর জন্য জার্মানির ক্ষতিপূরণ প্রচেষ্টার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল? কেন ইউক্রেন অবহেলিত ছিল? অর্থনৈতিক যুদ্ধ এবং ভূরাজনীতি সব হিসাবনিকাশের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। রাশিয়ান গ্যাসের অ্যাক্সেস ছাড়াই এবং গভীরভাবে পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিবেশে নতুন অংশীদার, মিত্র এবং বাজার খুঁজতে শুরু করেছে জার্মানি। এটা বুঝতে হলে জার্মান রাজনীতিবিদদের বিগত বছরের ভ্রমণপথগুলো দেখতে হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস গত মাসে এশিয়ায় এক সপ্তাহ কাটিয়েছেন—সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে গেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবকের সঙ্গে মি. স্কোলজও আফ্রিকাতে যথেষ্ট সময় কাটিয়েছেন। গত বছরের মে মাসে মহাদেশে একটি বিস্তৃত সফরে তিনি অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে আলোচনা করেছিলেন সেনেগালের সঙ্গে একটি গ্যাস চুক্তির বিষয় নিয়ে।

জার্মান প্রতিনিধিদলকে বেশির ভাগ অংশে সাদরে স্বাগত জানানো হয়েছে। তবু সবকিছু মসৃণ নয়। অনেক দেশেই জার্মানির প্রতি উত্তর-ঔপনিবেশিক অসন্তোষ রয়েছে। এবং জার্মানিকে তার সমস্ত প্রচেষ্টার জন্য উপনিবেশ স্থাপনকারী পশ্চিমের অংশ হিসেবেই দেখা হয়। বর্তমান সময়ে জার্মানি কেবল একটি সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে নিজেকে উপলব্ধিই করে না, বরং এটা সত্য যে ব্রিটিশ, ফরাসি, স্প্যানিশ ও ডাচ সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করলে জার্মানি পরে শুরু হয়েছিল এবং পরিধিতে ছিল ছোট। কিন্তু জার্মান সাম্রাজ্য আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম এবং পূর্বে, সেই সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তীর্ণ ভূমি দখল করেছিল। ১৯০৪ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত আজকের নামিবিয়াতে সংঘটিত হয়েছিল গণহত্যা। জার্মান ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহকারীদের নারী ও শিশুসহ মরুভূমিতে নির্বাসিত করেছিল, যেখানে অনেকেই অনাহার এবং পানিশূন্যতার কারণে মারা যায়। অন্যদের বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছিল। সব মিলিয়ে তখন হাজার হাজার মানুষ খুন হয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে  জার্মানি এই হত্যাকে গণহত্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, নামিবিয়ার কাছে ক্ষমা চায়। এবং ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিতে সম্মত হয়।

তবে জার্মান ইতিহাসের এই অধ্যায়টি জনসাধারণের খুব কম মনোযোগ পায়। জার্মানির স্কুলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই হলোকাস্ট সম্পর্কে শেখে; কিন্তু তারা আজও তানজানিয়া, রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডির কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত পূর্ব আফ্রিকা নামক জার্মান উপনিবেশে হেরো ও নামার গণহত্যা বা মাজি মাজি বিদ্রোহের ওপর নৃশংস ক্ল্যাম্পডাউনের কথা না-শুনেও সহজেই স্নাতক হতে পারে।

মনে রাখতে হবে, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের বিপরীতে বর্তমান অবকাঠামোতে আসার আগেই জার্মানি তার সাম্রাজ্য ত্যাগ করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের দানবতা এবং জার্মানির অন্যান্য নৃশংসতা দেশটির জনসাধারণের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। বর্তমানে জার্মানি ক্রমবর্ধমানভাবে বহুজাতিক রাষ্ট্র হয়ে উঠছে। ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, জার্মানির বাসিন্দাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী। একটি আরো বৈচিত্র্যময় প্রজন্ম সংসদে প্রবেশ করেছে এবং আঞ্চলিক ও জাতীয় সরকারেও তাদের অবস্থান দেখা যাচ্ছে। সুতরাং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আসবেই।

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগানও প্রভাব ফেলেছে জার্মানিতে। জার্মান ঔপনিবেশিকদের নামে বার্লিনের রাস্তার নামকরণ এবং আফ্রিকান শিল্পের চুরি হওয়া বস্তুর পুনরুদ্ধারের বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জার্মানি কিছু বেনিনের ব্রোঞ্জ শিল্প ফিরিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০টি শিল্পকর্ম, যা বর্তমান নাইজেরিয়া থেকে ব্রিটিশ সেনারা চুরি করে জার্মানির কাছে বিক্রি করেছিল।

সবাই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হবেন না—এটাই স্বাভাবিক। পঙ্কজ মিশ্রের বই ‘ফ্রম দ্য রুইনস অব এম্পায়ার’-এ ইউরোপ থেকে এশিয়ার বৌদ্ধিক মুক্তির বিষয় এবং ডেভিড ভ্যান রেব্রুকের বই ‘রিভোলুসি’ ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার লড়াইয়ের ইতিহাসের মতো বিষয়াদির মাধ্যমে মি. স্কোলজ নতুন পথের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর নেপথ্যে আমরা দেখতে পাই ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সন্ধান। শিক্ষার এই প্রক্রিয়াটি শুধু চ্যান্সেলরের জন্য নয়, সবার জন্য প্রয়োজন। জার্মানির ইতিহাস অনন্য কিন্তু নৃশংস। কিন্তু অন্যান্য দেশেরও জানার মতো ইতিহাস আছে। জার্মানি যদি নতুন বিশ্বে হারিয়ে যেতে না চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই তার অতীতের ভালো-খারাপ বিষয়াদি বিবেচনা করতে হবে এবং অন্যদের বেদনার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। সম্ভবত, সাময়িকভাবে ও সাবধানতার সঙ্গে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির এই যাত্রা শুরু করেছে জার্মানি। জার্মানি একটি কঠিন পাঠের প্রক্রিয়ায় পা রাখছে। জার্মানির এই পাঠ ইউরোপের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: জার্মান সাপ্তাহিক ডি সাইট-এর সম্পাদক ও লেখক

নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/650899/%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A0-%E0%A6%93-%E0%A6%87%E0%A6%89%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AC%E0%A6%A4%E0%A6%BE

Sponsors

spot_img

Latest

Calls For Bitcoin Legal Tender Grow After Milei’s Victory

Javier Milei is declared victorious in Argentina’s election. Bitcoiners hope Milei will make BTC legal tender...

Senate braces for last-minute conservative demands on debt deal

Stabenow, like many senators, foresees some Senate magic as the weekend gets closer and senators want to go home. But it could be...

Saudi Pro League now more valuable than Scottish Premiership but Premier League still dwarfs it

There is no denying the Saudi Pro League has taken over the transfer window this summer with some jaw-dropping moves. Once fancied as a...

Best early Cyber Monday tablet deals for 2023

UPDATE: Nov. 25, 2023, 12:15 p.m. EST We've updated this story with current Cyber Weekend pricing/availability, a new "best splurge" top pick, and...

Have a Cozy Thanksgiving! | Cup of Jo

How are you spending Thanksgiving, if you celebrate? The boys are heading upstate with Alex, but my dad is visiting Brooklyn, and we’re...