একজন সাবেক এবং একজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট। দুই জনের কাছেই সরকারি গোপন নথি পাওয়া গেছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে বাগবিতণ্ডা চলছে। সমালোচনাও কম নয়। কিন্তু তার পরও ট্রাম্প ও বাইডেনের বিচার এক হবে না। তদন্তে দুই জন স্পেশাল কাউনসেলরও (বিশেষ পরামর্শক) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে শাস্তি যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি তারা ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হলে জনগণ তা ভালোভাবে নেবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। এটি মোটেও অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে এসব নথিতে কী আছে সে সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। কিন্তু গোপনীয় বা অত্যন্ত গোপনীয় দলিলে সাধারণত এমন সব তথ্য থাকে, যা প্রকাশিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষতি হতে পারে।
ফের আলোচনার কেন্দ্রে সরকারি গোপন নথি : গত আগস্টে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাসায় সরকারি গোপন নথি পাওয়ার বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এবার সেই একই জিনিস পাওয়া গেল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বাসায় এবং সাবেক ব্যক্তিগত অফিসে। মার্কিন বিচার বিভাগ হোয়াইট হাউজ থেকে ট্রাম্পের সরকারি গোপন নথিপত্র সরিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছে। তদন্তের জন্য জ্যাক স্মিথ নামে একজন বিশেষ পরামর্শকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছাড়ার পর নথিগুলো ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে ট্রাম্পের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তদন্তকারীরা দেখছেন, এই নথিগুলো কীভাবে সেখানে সংরক্ষণ করা হয় এবং কে কে এগুলো দেখতে পেয়েছে। গত বছরের আগস্টে ফ্লোরিডা সৈকতের পাশে সাবেক প্রেসিডেন্টের বিশাল বাসভবনে তল্লাশি অভিযানে ১১ হাজার নথি জব্দ করে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। এর মধ্যে ১০০টি দলিল গোপন বলে চিহ্নিত করা ছিল। এর মধ্যে কয়েকটিকে ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ বলে লেবেল লাগানো ছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাবেক ব্যক্তিগত অফিস এবং বাড়ি থেকে অতিগোপনীয়সহ সর্বমোট ২০টি নথি উদ্ধার করা হয়েছে। ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তার বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, ওয়াশিংটন ডিসিতে পেন বাইডেন সেন্টার ফর ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড গ্লোবাল এনগেজমেন্টের অফিসে মোটামুটি ১০টি নথি উদ্ধার করা হয়েছে। এই নথিগুলোর মধ্যে কিছু নথি অতি গোপনীয় চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের নথি ফাঁস হলে গুরুতর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এছাড়া দুই দফায় দশটিরও কম নথি বাইডেনের ডেলাওয়্যারের উইলমিংটনে বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এই নথিগুলো অতি গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন এই নথি গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে উদ্ধার করা হলেও প্রকাশ্যে আসে এ মাসে। গত ১২ জানুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড আইনজীবী রবার্ট হুরকে উদ্ধার হওয়া গোপন নথিগুলো ভুলভাবে ব্যবহার হয়েছে কি না, তা তদন্তে বিশেষ পরামর্শক হিসেবে নিযুক্ত করেছেন।
অপরাধের সাজা : বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, সরকারি গোপন নথি অবৈধভাবে রাখায় তিনটি আইন ভঙ্গের বিচার হতে পারে। এর কোড নম্বর হচ্ছে ৭৯৩, ২০৭১ ও ১৫১৯। তিনটি আইনেই সরকারি গোপন নথির অন্যায় স্থানান্তর অপরাধ। তবে এটা ‘শ্রেণিবদ্ধ এবং শ্রেনিবদ্ধ না’ সেটা কোনো বিষয় নয়। আইন ৭৯৩ অনুযায়ী সরকারের প্রতিরক্ষাবিষয়ক তথ্য অবৈধভাবে কারো কাছে থাকা অপরাধ এবং এতে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ২০৭১ ও ১৫১৯ আইনে বলা হয়েছে, সরকারি নথি অবৈধভাবে গোপন করে রাখা বা ধ্বংস করে দেওয়ার শাস্তি তিন বছর থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড। ১৯১৭ সালে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি আইন পাশ হয়েছে, যাতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। প্রচারমাধ্যমের কাছে সরকারি গোপন তথ্য প্রকাশ করার জন্য মার্কিন নাগরিকদের বিরুদ্ধে ঐ আইনের প্রয়োগ ক্রমেই বাড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকার সংবাদপত্র, ব্লগ, বই বা অন্য কোনো প্রচারমাধ্যমে তথ্য প্রকাশের দায়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গুপ্তচরবৃত্তি আইনে অভিযুক্ত করেছে। গোপন তথ্য প্রকাশের দায়ে এডওয়ার্ড স্নোডেনও একই ঝুঁকির সম্মুখীন।
শাস্তির তারতম্য কেন : প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব শেষ করার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ন্যাশনাল আর্কাইভস বারবার নোটিশ দিয়েছিল যে তারা হোয়াইট হাউজের অনেক নথি পাচ্ছে না। সেগুলো তার কাছে থাকলে জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প জানুয়ারিতে ক্ষমতা ছাড়ার পর আগস্ট পর্যন্ত সেই সব নথি ফেরত দেননি। এরপর এফবিআই পরোয়ানা নিয়ে ট্রাম্পের মার-এ-লাগোর বাসায় অভিযান চালায়। ট্রাম্প এর কড়া সমালোচনা করেন। ঘটনা তদন্তে বিশেষ পরামর্শক নিয়োগ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল। ট্রাম্প কেবল বিচার বিভাগের নন, বিশেষ পরামর্শকেরও কঠোর সমালোচনা করেন। এমনকি তার পরিবার নিয়ে কথা বলতেও ছাড়েননি। অন্যদিকে বাইডেন নথি উদ্ধারের ঘটনায় ‘বিস্মিত’ হয়েছেন। তবে কোনো ভুল করার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জনগণ জানে আমি গোপনীয় নথিকে কতটা গুরুত্বসহকারে দেখি।’ বাইডেন জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তদন্তে তিনি মার্কিন বিচার বিভাগকে পূর্ণরূপে সহায়তা করবেন। আর নথি পাওয়ার পর সেগুলো ন্যাশনাল আর্কাইভসকে দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা আইনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও অলাভজনক আইনি ফার্ম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউনসেলরসের নির্বাহী পরিচালক কেল ম্যাকক্লানাহান বলেছেন, ট্রাম্পের মতো হয়তো বাইডেনও একই অপরাধ করেছেন। কিন্তু প্রসিকিউশন একটা বিষয় দেখে। তা হলো তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নেওয়া ও রাখা, যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা এবং তদন্তে যথাযথ সহায়তা করেছেন কি না। তার মতে, ট্রাম্পের কাছে বারবার সরকারি নথি চাওয়ার পরও ফেরত দেননি। বরং বারবারই সমালোচনা করেছেন এবং বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। অথচ বাইডেনের বাসায় নথি আছে, সেটা আপনি জানেন না। তিনি নিজেই সেগুলোর কথা জানিয়েছেন এবং ফেরত দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড জানিয়েছেন, বাইডেনের সহযোগীরা নথিগুলো গত ২ নভেম্বর পাওয়ার পর ডিসেম্বরে জানিয়েছেন এবং ন্যাশনাল আর্কাইভসকেও অবহিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইচ্ছাকৃতভাবে নথিগুলো সরিয়েছিলেন কি না এবং সেগুলো আটকে রেখেছিলেন কি না, তা দেখার জন্য হুরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিশেষ কৌঁসূলি রিচার্ড সবার বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা দেখাবে যে এই নথিগুলো অসাবধানতাবশত ভুল করে স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট ও তার আইনজীবীরা এই ভুল আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলাটি কেবল নথিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে নেওয়া হয়েছিল কি না তা নয়। সেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে রাখা হয়েছিল কি না, সেটাও তদন্তের বিষয়। জাতীয় নিরাপত্তা আইনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মার্ক জায়েদের মতে, ‘উদ্দেশ্যই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। দুটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। নথিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে যেখানেই নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, সেগুলো ফেরত চাওয়ার পরও ফেরত দেওয়া হয়েছিল কি না, তা জানতে হবে।’ সাবেক সিআইএ অ্যাটর্নি ব্রায়ান গ্রিয়ার বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ কখনোই অসাবধানতাবশত সরকারি নথি নিয়ে কাউকে অভিযুক্ত করেনি। কারণ বিচার বিভাগ ভালো কাজকে উত্সাহ দেয়। কেউ যদি ভুল করে নিয়ে যায় এবং পরে ফেরত দেয়। তার পরও যদি বিচার বিভাগ তার বিরুদ্ধে মামলা করে, তখন যে কেউ সরকারি নথি ফেরত দিতে নিরুত্সাহবোধ করবেন।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকায় একটা সুরক্ষা পাবেন। কারণ, কোনো প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনে এক বিশ্লেষণে রাজনীতিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ লেখক জাচারি বি উলফ বলেছেন, সময়টা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য সমস্যা হতে পারে। তার আইনজীবীরা সরকারি গোপন নথি গত ২ নভেম্বর বাইডেনের সাবেক ব্যক্তিগত অফিসে এবং ডিসেম্বরে বাড়িতে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে এলো এই মাসে। এমনকি বাড়িতে পাওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়নি। সিএনএনের স্টিফেন কলিনসন লিখেছেন যে এর মাধ্যমে হয়তো বাইডেন কিছু লুকানোর চেষ্টা করেছেন। যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারা নথি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ন্যাশনাল আর্কাইভসকে জানিয়েছেন।