সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক মারধরের ঘটনায় আলোচনায় আসে শিক্ষার্থীদের অপরাধী চক্র ‘প্রলয় গ্যাং’। ক্যাম্পাসে গ্যাং কালচার উৎপত্তির ক্ষেত্রে আবাসন সংকটকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, হলগুলোতে যে হারে নতুন শিক্ষার্থী উঠছে সে হারে হল থেকে নামছেন না সাবেক শিক্ষার্থীরা। ফলে হলে হলে কৃত্রিম সিট-সংকট তৈরি হয়েছে। আবার রাজনৈতিক কারণে সেই সংকট আরো তীব্রতর হচ্ছে। যার কারণে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা নিরুপায় হয়ে অবস্থান করছেন হলের গণরুমগুলোতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রলয় গ্রুপের এক সাবেক সদস্য জানান, প্রথম বর্ষে থাকাকালে প্রায় সময়ই মাঝ রাতে হল থেকে বের করে দেওয়া হতো। বিভিন্ন হলের সবাই মিলে র্যান্ডমলি আড্ডা দিতাম ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায়। সেই সংঘবদ্ধ ঘোরাফেরা ও আড্ডা থেকেই মূলত সংঘবদ্ধভাবে মাদকসেবনসহ অন্যান্য অপরাধ কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরি হয়। ধীরে ধীরে প্রসার হতে থাকে গ্যাং কালচারের।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, উন্নত টেকনোলজির কারণে আমাদের সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অঙ্গনের জায়গাগুলোয় শিক্ষার্থীদের বিচরণ সীমিত হয়ে আসছে। যার কারণে শিক্ষার্থীরা ড্রাগ অ্যাডিকশন, গ্যাং কালচার, জুয়াসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাং কালচার তৈরির পেছনে আবাসনসংকট অন্যতম একটি কারণ। আবাসন সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের অসুবিধা হয়, তাদের আচরণেও পরিবর্তন আসে এবং তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যাং কালচারের উৎপত্তি আমাদের জন্য নতুন একটি বিষয়। আমরা যদি শিক্ষার্থীদের কালচারাল অ্যাকটিভিটিস, ডিবেটিং ও নানান ধরনের ক্রিয়েটিভ অ্যাকটিভিতে যুক্ত করতে পারি তবেই তারা ছিনতাই চাঁদাবাজিসহ অনন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সচেষ্ট হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা যেন অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারেন সেজন্য তাদের রিক্রিয়েশন ও ক্রিয়েটিভ অ্যাকটিভিটিসের জন্য স্পেস বাড়ানো প্রয়োজন। আবাসন ব্যবস্থাকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। এছাড়া যারা এ ধরনের অন্যায় অপরাধ করছে তাদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা উচিত। এতে করে শিক্ষার্থীরা সতর্ক হবেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, আমাদের আবাসনসংকট একদিনের নয়। অনেক দিন থেকেই আবাসনসংকট তৈরি হয়ে আছে। শুধু আবাসনসংকটের কারণেই শিক্ষার্থীরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বিষয়টি এমন নয়। হঠাৎ করে কিছু শিক্ষার্থীর অপরাধপ্রবণ হয়ে যাওয়ার মানসিকতা তাদেরকে অপরাধে যুক্ত করেছে। আইনিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেবল অপরাধ সীমিত করা সম্ভব। পাশাপাশি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে যদি সকলে এগিয়ে আসে তবে এমন অপরাধের মানসিকতা সমাজ থেকে দূরে সরে যাবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি জায়গায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আছে। যখনই যে প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে আসে আমরা তাদের অভিযোগ শোনার চেষ্টা করি। আমাদের কাছে যদি শুরুতেই শিক্ষার্থীদের মাদক গ্রহণের অভিযোগ আসত তাহলে প্রথম থেকেই আমরা তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নিতাম। সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব।
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এখানে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থায় অনেক বড় দুর্বলতা আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। আর সেই কারণে একজন শিক্ষার্থী অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে না। তবে সব শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, শিক্ষা ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় জড়িত থাকবে, গবেষণায় জড়িত থাকবে—এটাই প্রত্যাশিত। এই সীমাবদ্ধতা মাথায় নিয়েই অনেক শিক্ষার্থী সাফল্যের শিখরে উঠে যাচ্ছে। যারা অন্তর থেকে ভালো, নিজেকে সত্যিকারের মানুষ হিসাবে গড়তে চায়, সমাজে সবার সামনে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায় সর্বোপরি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে চায়, তারা তো কোনো অজুহাত দেখিয়ে অপরাধমূলক কাজে জড়াচ্ছে না। তাই প্রতিটা শিক্ষার্থীর পরিবারকেও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি।