তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন এবং সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব


বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অবিরত। প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুততম সময়ে দেশে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবন-জীবিকারও উন্নয়ন ঘটছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে বিশ্বের কোথায়, কখন, কী ঘটছে—তা মুহূর্তের মধ্যে জানতে পারছি। নিত্যনতুন ধ্যানধারণা, উন্নয়নের গতিধারা সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি। উন্নয়নের এ গতিধারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে। এক কথায় বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। চিঠিপত্র আদান-প্রদান, টাকাপয়সা লেনদেন বা যে কোনো পণ্যসামগ্রী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনা-নেওয়া এখন সময়ের ব্যবধান মাত্র। কিছু দিন আগেও আমাদের ডাকঘরে ছুটে যেতে হতো। দিনের পর দিন টেলিগ্রাম, মানিঅর্ডার বা চিঠিপত্রের জন্য ডাকপিয়নের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে হতো। এখন সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মোবাইল ব্যাংকিং, বিকাশসহ বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন হচ্ছে। অনলাইন, ই-শপ ইত্যাদির মাধ্যমে ঘরে বসে যে কোনো পছন্দমতো দ্রব্যাদি ক্রয় করতে পারছি। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে আমাদের নিরাপত্তা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হয়েছে। উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধী শনাক্ত করতে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। যানবাহনের সুবিধার জন্য ব্যবহার হচ্ছে উবার-পাঠাও। ভূমিকর, পৌরকর ইত্যাদি করসমূহ অনলাইনের মাধ্যমে প্রদান সহজ হয়েছে। এক কথায় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বহুবিধ সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দেশে এমন কোনো পরিবার নেই, যেখানে মোবাইল ব্যবহার হচ্ছে না। দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল একটি অতি আবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। প্রবাসীরা ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তাদের স্বজনদের খোঁজখবর নেওয়াসহ ভাববিনিময় করতে পারছেন।

আজ যে প্রসঙ্গ বা বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি, তা হচ্ছে প্রযুক্তির এ উন্নয়ন আমাদের পরিবার এবং সমাজ জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করছে? প্রতিটি উন্নয়ন বা আবিষ্কারের সুফল এবং কুফল দুটিই রয়েছে। উন্নয়নের এ সুফল এবং কুফল দুটিই জীবনকে কতটুকু প্রভাবিত করছে, ভালোটাকে আমরা কতটুকু গ্রহণ করছি এবং খারাপ বা ক্ষতিকর দিকটি কতটুকু বর্জন করছি সেটাই বিচার্য। বিষয়টি নিয়ে গভীর বিচার-বিশ্লেষণ বা গবেষণার দাবি রাখে। গবেষণার ফলাফল শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে স্নেহ, মমতা ভালোবাসার মতো আবেগ-অনুভূতিগুলোকে। জানা মতে, দেশের অধিকাংশ পরিবারে প্রযুক্তির মন্দ প্রভাব মারাত্মভাবে বিঘ্নিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমরা অভিভাবকরা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সুবিধাসহ ল্যাপটপ তুলে দিচ্ছি। বর্তমান প্রজন্ম এতটাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, ঘরে বা পরিবারে অসুস্থ রোগী থাকলেও খবর নেওয়া বা সেবাযত্ন করার মতো সময় বা মানসিকতা কোনোটাই তাদের নেই। অবুঝ সন্তানরা লেখাপড়ার চেয়ে সিনেমা, গান, সিরিয়াল, টিকটক, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি ক্ষতিকর বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোনো বই পড়তে চায় না। স্বল্প শ্রমে কীভাবে একটা ভালো রেজাল্ট করে ওপরে ওঠা যায়, সেটাই একমাত্র লক্ষ্য। শুধু সন্তানদের কথাই-বা বলি কেন, অবিভাবকরাও স্মার্ট ফোনের প্রতি নেশাগ্রস্ত হওয়ায় সন্তানদের দিকে সুদৃষ্টি দেওয়ার সময় পাচ্ছেন না। সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, লেখাপড়া ঠিকমতো করছে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখভাল করতে না পারায়, অনেক পরিবারেই উঠতি বয়সের সন্তানদের নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। স্মার্টফোন ছোট-বড় সবাইকে মাদকের মতো নেশাগ্রস্ত করে ফেলেছে। পারিবারিক বন্ধনগুলোকে ঢিলে করে ফেলেছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই স্বামী স্ত্রীর প্রতি, স্ত্রী স্বামীর প্রতি, সন্তান বাবা-মায়ের প্রতি, বাবা-মা সন্তানের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার বন্ধন থেকে দূরে সরে আসছে। উল্লেখ্য, বাবা-মায়ের স্মার্টফোন আসক্তির কারণে কিছু দিন আগে জার্মানির হামবুর্গে শিশুরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে। তাদের স্লোগানের ভাষা ছিল ‘আমরা পথে কারণ, আমাদের বাবা-মায়ের চোখ মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে।’ ‘আমার সঙ্গে খেলা করো, স্মার্টফোন নিয়ে নয়’ বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্টফোন আসক্তির ফলে সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের আচরণ বদলে যাচ্ছে। তারা উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। এটি মাদকের মতো জীবন ও পরিবারের বন্ধনকে ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা আর অগের মতো ভিড় জমায় না। বই পড়ার চেয়ে স্মার্টফোনের দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি। পড়াশোনার দিকে তাদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে না। যদিও গাদা গাদা ছাত্রছাত্রী জিপিএ-৫ নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পার হলেও চাকরির বাজারে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আজকের দিনের মতো যখন প্রযুক্তির আধিক্য ছিল না, তখন পরিবারগুলোর মধ্যে একটা নিবিড় বন্ধন ছিল। ছিল স্নেহ, আদর, ভালোবাসায় ভরা। ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু বাস্তবে এখন সেটি হচ্ছে না। ফোনের আসক্তি সম্পর্কগুলোর বাঁধনকে আলগা করে দিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো, ভালোবাসার বন্ধনে জড়ানো, যা পশ্চিমা দেশগুলোতে নেই। পশ্চিমা সমাজব্যবস্থার মতো আমাদের পরিবার বা সমাজব্যবস্থা না। কিন্তু আমাদের সেই ঐতিহ্য, সেই পারিবারিক বন্ধনটা ধীরে ধীরে ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। আমরা হারিয়ে যাচ্ছি কালের গর্ভে। বাবা-মা, ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-ফুপু, খালা-খালুসহ স্বজনদের সবার মধ্যে, এমনকি প্রতিবেশীদের মধ্যেও একটা হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সবাই নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করত। এক জনের বিপদে অন্যজন পাশে গিয়ে দাঁড়াত। আজকাল এই আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কগুলো আর তেমনভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিবারের সবার সঙ্গে হাসি-আনন্দ ভাগাভাগি করার চেয়ে স্মার্টফোনের মধ্যে ডুবে থাকতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এর ফলে পরিবারের অন্য সদস্যদের চেয়ে প্রবীণ সদস্যরা একাকিত্বের যন্ত্রণায় ভুগছেন বেশি। শুধু তাই নয়, রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময়ও ফোনে নিমগ্ন থাকায় পথেঘাটে কত অঘটন ঘটছে তার হিসাব নেই। গাড়িচালকরা গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহার করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আইন করে নিষিদ্ধ করা হলেও এ আইনের কোনো কার্যকারিতা নেই। মেয়েদের লাইফ প্রোগ্রামে বিভিন্নভাবে তুলে ধরে হেনস্তা করা হচ্ছে। যৌন নিপীড়নমূলক অশ্লীল ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে। অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তি পর্যায়েও ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। ইন্টারনেটে নোংরা অশ্লীল পর্নোগ্রাফি শিশু-কিশোরদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে অনেকে ভোক্তাদের বিভিন্নভাবে প্রতারিত করছে। কিশোর গ্যাং মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতে করে সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এজন্য সন্তানদের পারিবারিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে হলে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবশ্যই চলতে হবে। তবে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে তথ্য আইনের সদ্ব্যবহার করতে হবে। আর তা করতে না পারলে যত উন্নয়নই হোক না কেন, পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় আমাদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে, যা কখনই কারো কাম্য নয়।

লেখক: অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/652234/%E0%A6%A4%E0%A6%A5%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC

Sponsors

spot_img

Latest

Joe Mixon official status for Titans game, revealed

The Cincinnati Bengals will be without one of their top playmakers for a key Week 12 showdown between AFC contenders.Running back Joe Mixon...

The Future of Media Literacy Education

In the age of TikTok, teen depression, and information overload, parents and lawmakers have increasingly turned to K-12 schools to teach students how...

Luis Enrique flies in for Chelsea talks but Frank Lampard could be a caretaker option

Equally, Chelsea are prepared to act fast in attempting to speak to all the names on their list and will not waste any...

Nick Offerman, Megan Mullally Join Season 4

When Netflix’s The Umbrella Academy returns for its fourth and final season, it won’t just have a new timeline, it’ll also bring some...

‘Quordle’ today: See each ‘Quordle’ answer and hints for January 8

If Quordle is a little too challenging today, you've come to the right place for hints. There aren't just hints here, but the...