বিপুল বিস্ময় লইয়া আজ আমরা স্মার্ট মোবাইল ফোনের ছোট্ট পর্দার দিকে তাকাইয়া থাকি। অপলক তাকাইয়া থাকি স্যাটেলাইট টিভি কিংবা ইন্টারনেট-যুক্ত ল্যাপটপের পর্দায়। কী নাই সেইখানে! প্রযুক্তি আমাদের রূপকথার জগতে ঢুকাইয়া দিয়াছে। এককালে যাহা আমরা কল্পবিজ্ঞান কিংবা রূপকথায় পড়িতাম, আজ তাহাই বাস্তবে দেখিতেছি! অপূর্ব বৈচিত্র্যে ভরা এই প্রযুক্তির জগত। আমরা এইখানে শুধু অবাধ তথ্যপ্রবাহের কথাই বলিতে পারি। সেই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় শতবর্ষ পূর্বে বলিয়া গিয়াছেন, ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’, তাহাই আজ বাস্তব। কত জায়গায় কত কিছু সংগোপনে ঘটিয়া চলিতেছে। কত ধরনের গোপনীয় তথা ক্লাসিফাইড তথ্য হ্যাকিং হইয়া প্রকাশ পাইয়া যাইতেছে। আর যাহা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ তাহা হইল—অন্যায়, অপরাধ, অমানবিকতা ও যুদ্ধের ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছাইয়া যাইতেছে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে। পৃথিবীর যে কোনো জায়গা হইতে আধুনিক ডিভাইস ও অ্যাপসের মাধ্যমে ‘লাইভ’ দেখানো এখন এতটাই সহজ ও স্বাভাবিক যে, চলতি ঘটনা মানুষ মুহূর্তেই জানিয়া যাইতেছে। আর তথ্যের এই অবাধ প্রবাহের ফলে বিশ্বের মানুষ বুঝিতে পারিতেছে—কত ধরনের নৃশংসতা ও অমানবিকতার ঘটনা ঘটিতে পারে! আর তাহা দেখিয়া দেখিয়া সংবেদনশীল কোনো মানুষ ভাবিতে পারে—ইহাকে কি সভ্য পৃথিবী বলা যায়?
আদিম যুগে মানুষ গুহায় বাস করিত, কাঁচা মাংস ও ফলফলাদি খাইত, পোশাক ছিল গাছের ছালবাকল, পায়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনোভাবেই চলাফেরা করিতে পারিত না। সামান্য রোগে বা আঘাতের সংক্রমণে মারা যাইত। কিন্তু এখন উচ্চবিত্ত তো বটেই, কোটি কোটি মধ্যবিত্তেরও আছে সুন্দর বাড়ি। তাহারা প্রতিনিয়তই বিচিত্র রেসিপির অপূর্ব স্বাদের খাবার, বাহারি পোশাক আর আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পাইতেছে। জীবনকে উপভোগ করিবার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এই পৃথিবীকে যেন স্বর্গতুল্য করিয়া তুলিয়াছে! কিন্তু ইহা হইল মুদ্রার একটি দিক। অপর দিকটি হইল—যুদ্ধ, হিংসা, নৃশংসতা আর মানবতা হরণের ভয়ংকর সকল ঘটনা। মানুষ যখন সভ্য হইয়া উঠে নাই, তখনো আধিপত্য বিস্তারের জন্য কাদা ছোড়াছুড়ি করিয়াছে। প্রস্তর যুগ হইতে শুরু করিয়া আধুনিক এই তথাকথিত সভ্য সময় পর্যন্ত মানুষ লক্ষাধিক বড় বড় যুদ্ধ করিয়াছে। এই অবধি ঠিক আছে। কিন্তু পৃথিবীটাকে অমরাবতী করিবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এবং মানুষের আরও মানবিক হওয়াটা স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও এখনো কেন যুদ্ধের নূতন নূতন আয়োজন চলিতেছে? বিশ্ব জনমতের তোয়াক্কা না করিয়া বিভিন্ন দেশে নিরপরাধ নারী-শিশুসহ বেসামরিক মানুষকে এখনো কেন হত্যা করা হইতেছে?
যুদ্ধবিজ্ঞানে বলা হয়, ক্ষমতার মদমত্তে মানুষের মনস্তত্ত্ব জটিল হইয়া যায়। যুদ্ধ মূলত আয়োজিত হয় মানুষের মনে। আমরা দেখিতেছে, বিংশ শতাব্দীতে আনুমানিক ১৬৫টি যুদ্ধে প্রায় ২৫ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়াছে। পরিতাপের বিষয় হইল—বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন যুদ্ধে নিহতের ৭৫ শতাংশই হইলেন বেসমারিক নাগরিক, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও দরিদ্র মানুষ। এই যে সাধারণ মানুষ মারা যাইতেছে, নিজ ভূমি হইতে পালাইয়া অন্য দেশে শরণার্থী হইতেছে—এই ক্ষতি তো মানবতার। এই লজ্জা তো সমগ্র মানবজাতির। আমরা যেহেতু এখন আর আদিম যুগে বসবাস করিতেছি না, তাহা হইলে আমাদের কার্যকলাপ কেন এখনো আদিম যুগের চাইতেও লজ্জাজনক হইবে? মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে সৃষ্টি করিয়াছেন। মানুষ কেন তাহার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিতে পারিবে না? ভূপেন হাজারিকার একটি গানের লাইনে বলা হইয়াছে—‘মানুষ যদি সে না হয় মানুষ, দানব কখনো হয় না মানুষ। যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ, লজ্জা কি তুমি পাবে না?’ যাহারা যুদ্ধবাজ মানবতা হরণকারী, সম্ভবত তাহাদের অন্তর্চক্ষুতে ‘লজ্জা’ বলিয়া কিছু নাই। কিন্তু ইহা মনে রাখিতে হইবে, এখন যাহারা যুদ্ধাপরাধ করিতেছেন, যাহাদের যুদ্ধোন্মাদনার জন্য হাজার হাজার নিরীহ প্রাণ বলি হইতেছে, তাহাদেরও একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে হইবে। ইতিহাসের নিকট কোনো অপরাধের ক্ষমা নাই।