দালাল ও দালালি


‘দালাল’ শব্দটি আমাদের অত্যন্ত পরিচিত। শব্দটি সাধারণত নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয়। যদিও নেতিবাচক অর্থে ব্যবহারের কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। নগদ টাকা বা অন্য কিছুর বিনিময়ে কারো পক্ষে সাফাই গাওয়া বা কারো হয়ে কোনো কাজ করে দেওয়া অথবা কারো স্বার্থোদ্ধারে ভূমিকা পালন করাই একজন দালালের কাজ। দালাল অনেক সময় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। দুইটি পক্ষের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে দেয়। সেতুর ভূমিকা পালন করে। ঠিকমতো দালাল ধরতে পারলে আমাদের অনেক স্বার্থই অনায়াসে সিদ্ধি হয়। আবার অনেক সময় দালালের খপ্পরে পড়ে অনেক ক্ষতি ও বিড়ম্বনাও মেনে নিতে হয়।

দালালকে ইংরেজিতে বলে ব্রোকার (Broker)। শেয়ারের দালাল হলেন স্টক ব্রোকার। দুইটি অভিধানে দালাল শব্দটির দুই রকম অর্থ দেওয়া আছে। ‘চলন্তিকা’ বলছে দালাল মানে হলো যে ব্যক্তি ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার যোগ ঘটায়। ‘দালাল’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কমিশনের বিনিময়ে যে ব্যক্তি ক্রেতা ও বিক্রেতাকে ক্রয়-বিক্রয়ে সাহায্য করে; ক্রেতা বা মালপত্র সংগ্রহকারী। ব্যবসায়-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদিতে যে ব্যক্তি মধ্যস্থের কাজ করে; (নিন্দায়) অযৌক্তিকভাবে কারো পক্ষ অবলম্বনকারী বা পক্ষসমর্থনকারী (সরকারের দালাল, মালিকের দালাল)। শব্দটির বিশেষণ হিসেবে ব্যবহূত হয় ‘দালালি’। এর মানে হচ্ছে দালালের বৃত্তি বা কাজ; দালালের প্রাপ্য পারিশ্রমিক (দালালির টাকা); (নিন্দায়) অন্যায়ভাবে মধ্যস্থতা বা পক্ষসমর্থন।

পরের উপকার করা জগতে সবচেয়ে প্রশংসনীয় কাজ। একজন দালাল সব সময় এ কাজটিই করেন। দালাল কখনো নিজের দালালি করেন না, সব সময়ই তিনি পরের দালাল। কোনো ব্যক্তির, দলের, প্রতিষ্ঠানের কিংবা ভিন্ন কোনো দেশের। যারই হোক না কেন, দালালি দালালিই। পরের উপকার করা। পরের প্রচার করা, পরের হয়ে কাজ করে দেওয়া। কখনো কখনো তাতে কিঞ্চিত্ অর্থলাভ হয়, কখনো অর্থলাভ বেশি, কখনো অর্থলাভ ছাড়া শুধুই আনন্দ লাভ হয়, কখনো বিনা লাভেই দালালি। এমনকি কখনো কখনো নিজের অর্থ-সময়-শ্রম ব্যয় করেও মানুষ দালালি করে যায়।

দালাল হচ্ছে তৃতীয় পক্ষ। আমাদের তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গরু-ছাগল কেনাবেচার মতো তুচ্ছ বিষয় থেকে শুরু করে বিয়ে, জমি কেনা, বাড়ি বানানো, বড় অস্ত্রের চালান কেনার বড় বিষয়ে পর্যন্ত দালাল ধরতে হয়। এই মধ্যস্থতাকারী বা দালালের মাধ্যমেই আমরা অনেক জটিল ও কঠিন কাজ উদ্ধার করি। দালাল ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তার পরও কেন জানি দালালকে আমাদের দেশে ভালো চোখে দেখা হয় না।

‘দালালি’ হচ্ছে একধরনের ওকালতি, কারো পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা বা কথা বলা। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে প্রত্যেক মানুষই কারোর না কারোর পক্ষে কখনো না কখনো ওকালতি করে; অর্থাত্ দালালি করে। দালালি কমবেশি সবাই করে; কিন্তু কেউই দালাল হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। এটা মানুষের চরিত্রের একটি আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য!

আমাদের দেশে নানা ধরনের দালাল আছে। গরুর দালাল, জমির দালাল, থানার দালাল, বিদেশে লোক পাঠানোর দালাল, বিআরটিএর দালাল, হাসপাতালের দালাল, কোর্টের দালাল, বিমার দালাল, যৌনকর্মীদের দালাল, পাসপোর্ট অফিসের দালাল, সচিবালয়ের দালাল, রাজনৈতিক দালাল, বিয়ের দালাল। তবে কিছু কিছু দালাল আছে, যারা অত্যন্ত ভয়ংকর ও ক্ষতিকর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানের দালাল হিসেবে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছে, সেই রাজাকার-আলবদর চক্র হচ্ছে তেমনি ভয়ংকর ও ক্ষতিকর দালাল।

দালাল শব্দটি অসম্মানজনক নয়। রাজনৈতিক প্রসঙ্গে দালাল শব্দটির অর্থের অধঃপতন হয়েছে। আজকাল কেউ চট করে স্বীকার করবেন না যে তিনি দালাল, কিংবা তার কেউ দালালি করেন।

আমাদের দেশে রাজনীতিতেও দালাল শব্দটি বহুল ব্যবহূত। পাকিস্তানের দালাল, ভারতের দালাল, আমেরিকার দালাল, চীন বা রাশিয়ার দালাল। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে কোনো না কোনো দেশের দালাল হিসেবে অভিহিত করে। আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দলই দালালির অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। এ দেশের মানুষগুলোও দালালির অভিযোগে অভিযুক্ত। কেউ আওয়ামী লীগের দালাল তো কেউ বিএনপির দালাল। সংবাদপত্রগুলো পর্যন্ত কোনো না কোনো দলের দালাল হিসেবে চিহ্নিত। এ বিএনপির, তো ও আওয়ামী লীগের। এ দেশের রাজনৈতিক দল, সংবাদপত্র, নেতা, বুদ্ধিজীবী, জনগণ কারোরই কোনো স্বতন্ত্র সত্তা বা পরিচয় নেই। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো দেশ বা দলের ‘দালাল’!

দালালি এক আজব জিনিস। এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে মিছিলে আকাশ-ফাটানো স্লোগান উচ্চারণ করে—অমুকের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান অথবা বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলে—দালালি আর করিস না, পিঠের চামড়া থাকবে না। দেখা যায় যারা অমুক দেশ বা অমুক দলের দালালির বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারাও অন্য কোনো দেশ বা দলের পক্ষেই ভূমিকা পালন করছে বা দালালি করছে। ব্যাপারটা গোলমেলেও বটে। যখন অভিযোগ তোলা হয়—অমুক দল বা অমুক নেত্রী অমুক দেশের দালাল, তখন এমন একটা ভাব প্রকাশ পায়, যেন অমুক দেশের দালালি করাটাই জঘন্যতম অন্যায়; ঐ নির্দিষ্ট দেশটি বাদ দিয়ে অন্য কোনো দেশের দালালি করলে সেটা মোটেও দোষের নয়। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন দল ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন দেশ অথবা দলের দালালির অভিযোগ চলতেই থাকে। সেদিক থেকে আমাদের দেশকে ‘দালাল পরিবৃত্ত’ একটি দেশ বলা যায়, যেখানে একে অপরের কাছে দালালির অভিযোগে অভিযুক্ত বা দালাল বলে পরিচিত!

সাধারণত ছোট দেশ বড় দেশের দালালি করে। দুর্বল সবলের পক্ষে দালালি করে। প্রবল বা সবলরা অনেক ক্ষেত্রে দালাল সৃষ্টি করে। অন্যভাবে বলা যায় দালাল পোষে। এতে তার স্বার্থসিদ্ধি সহজ হয়। ক্ষুদ্ররা বৃহতের আনুগত্য ও আনুকূল্য লাভের আশায় চিরকাল অকাতরে দালালের খাতায় নাম লেখায়। এটাই জগতের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কোনো বৃহত্ শক্তি কোনো ক্ষুদ্র শক্তির দালাল হয়েছে—এমনটা সচরাচর দেখা যায় না।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও দালালির অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। আমাদের রাজনীতি ‘ভারতের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না’, ‘আমেরিকার সমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় থাকা যাবে না’—এ ধরনের ধারণা দ্বারা পরিচালিত। আর তাই তো নির্বাচনের আগে দিল্লিতে ভিড় জমে ওঠে বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের নেতানেত্রীদের। সলাপরামর্শ চলে ইংল্যান্ড-আমেরিকার নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে। বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা, অভিযোগ-নালিশ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাত্ বিদেশি শক্তির দালালির চিন্তামুক্ত রাজনীতি বড় বেশি দেখা যায় না।

দেশটা আমাদের, এই দেশের ক্ষমতায় কারা থাকবে কারা যাবে সেটা নির্ণয় আমরা করব, দেশের মানুষ করবে। অবশ্যই কোনো বিদেশি শক্তি নয়—এই বোধ ও উপলব্ধি আমাদের রাজনীতি থেকে যেন নির্বাসিত। বিদেশিরা আমাদের বন্ধু বা উন্নয়ন সহযোগী হতে পারে, কিন্তু কোনোমতেই প্রভু নয়—এই আত্মবিশ্বাস থেকে আমাদের রাজনীতি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।

বিদেশি প্রভুরা কোনো দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে—এই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে না পারলে আমাদের রাজনীতির মেরুদণ্ড কখনোই সোজা হবে না। ভাবতে হবে বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে, তারা যদি আপনার পক্ষে দাঁড়ায় তখন বিদেশি শক্তির দরকার হবে না। আর জনগণ যদি আপনার পক্ষে না দাঁড়ায়, তাহলে কোনো বিদেশি শক্তির পক্ষে সম্ভব নয় বাংলাদেশের কোনো দলকে ক্ষমতায় রাখা। সেটা ভারত, পাকিস্তান, চীন, আমেরিকা কারোর পক্ষেই সম্ভব হবে না।

দালালি করতে হলে বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে করতে হবে। পরিশেষে আহ্বান—আসুন, আমরা পাকিস্তান, ভারত, চীন, রাশিয়া, আমেরিকা নয়, সবাই বাংলাদেশের দালাল হই। বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় জীবন উত্সর্গ করি। একাত্তরের বীর শহিদেরা যা করেছিলেন।

পুনশ্চ :

মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধবও দালালি করে, দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কেন? বন্ধুকে বাঁচাতে। তেমন এক কাহিনি।

কিশোর সারোয়ার দেরি করে বাড়ি ফিরল। বাবা জিগ্যেস করলেন, ‘এত দেরি হলো কেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’

সারোয়ার বলল :বন্ধুর বাসায়।

বাবা ছেলের সামনেই তার দশ জন বন্ধুকে ফোন দিলেন। ফোনে জিগ্যেস করলেন, ‘সারোয়ার কি তোমাদের বাসায় গেছে?’

এই প্রশ্নের উত্তরে চার জন বলল : ‘ও তো এতক্ষণ এখানেই ছিল!’

দুই জন বলল : ওহ্ আংকেল, সারোয়ার তো আমাদের বাসাতেই ছিল, এইমাত্র বের হয়ে গেল!

তিন জন বলল : ‘সারোয়ার তো আমার বাসায় পড়ছে। ওকে কি ফোনটা  দেব?’

শেষের জন আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে। সে বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, বলো!’

লেখক: রম্যরচয়িতা





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/648985/%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%93-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF

Sponsors

spot_img

Latest

On-Chain Data Shows Signs Of Fresh Bitcoin Accumulation

On-chain data shows signs of some fresh Bitcoin accumulation taking place during the last month. Bitcoin UTXOs Aged 1 Week To 1 Month Have...

Record-Breaking ‘Defense’ Bill Wastes Unfathomable Amounts on Dysfunctional, Unwanted Weapons Systems

The business of war has always been an excellent business to be in. Unfortunately, this fiscal year seems to be another banner year...

New Zealand v England first Test LIVE commentary: Stuart Broad returns as Ben Stokes’ side look to continue excellent form ahead of the Ashes

England are finally back in Test action as Ben Stokes’ side take on New Zealand in a two-match series. Coach Brendon McCullum and captain...

Binance’s CZ Tells Investors ‘Ignore Fud. Keep Building!’ as the Community Warns of Red Flags

Binance Coin ($BNB) is down 5.9% in the past seven days, with other top cryptocurrencies outperforming it. Investors are concerned about ‘red flags’ following...

What Do Britain’s Scaleups Want From The “Science Superpower” Agenda?

There’s nothing a politician likes better than a mantra - a phrase that can be repeated again and again until, possibly, thought becomes...