রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন একটি যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করেছে। চীনসহ নতুন বিশ্বশক্তির উত্থান ঘটিয়েছে। এটি হতে চলেছে বহুমেরু বিশ্ব, যেখানে ভিন্ন শাসন পদ্ধতি ও মূল্যবোধ একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। বাড়বে ক্ষমতা ও প্রভাববলয় বাড়ানোর চেষ্টা।
জার্মানির কথাই ধরা যাক। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা বহাল রাখতে দেশটি এখন সদাই তৎপর। জাতিসংঘ মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে বিশ্বব্যবস্থা; তার মূল কথা হচ্ছে গণতন্ত্র, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য কিছু অভিন্ন নীতি অনুসরণ প্রয়োজন। এ কারণে জার্মানি ইউরোপীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানকারী হতে ইচ্ছুক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সেতুবন্ধনের দায়িত্বটি জার্মানি নিতে চায়। এর মধ্য দিয়ে বাইরের দুনিয়াকেও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার বার্তা দিতে চায় দেশটি। এই উদ্দেশ্যে জার্মানি ‘জেইটেনওয়েন্ডে’ উদ্যোগটি নিয়েছে। এটি একটি জার্মান শব্দ, যার অর্থ সন্ধিক্ষণ। এটি হবে বৃহত্তর ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি। ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা এবং ইউরোপীয় ইস্যুগুলোর বাইরেও দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে এতে। মূল কথা হলো, বিশ্বে যখন ক্রমেই বহুমেরু বা নতুন নতুন মেরুকরণ ঘটছে, ইউরোপ তখন কীভাবে স্বাধীন সত্তা বজায় রাখবে?
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর তিনটি দশক পার হয়েছে। আঞ্চলিক যুদ্ধবিগ্রহ সত্ত্বেও মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সময় ছিল। এই সময়ের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়েছে। বেড়েছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য। দারিদ্র্যবিমোচনও হয়েছে দ্রুত। যদিও বিশ্ব পুরোপুরি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত হয়নি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটলেও একই সঙ্গে একনায়ককেন্দ্রিক শক্তিরও উত্থান ঘটেছে। এই সময়ে রাশিয়ার প্রতিও ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। রাশিয়াকে পূর্বসূরি সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে সহযোগী হিসেবে দেখা শুরু করল। অনেক ইউরোপীয় দেশই দেখল, রাশিয়া এখন আর আগের মতো নিরাপত্তা হুমকি নয়। তাই বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেট কাটছাঁট শুরু করে ইউরোপের দেশগুলো। এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে জার্মানি। সোভিয়েত আমলে দেশটিকে ৫ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী পুষতে হতো। সোভিয়েত পতনের পর সেই প্রয়োজনীয়তা থাকল না।
১৯৯০-এর দশকে বলকান যুদ্ধ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার পর ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। ন্যাটোর ইতিহাসে প্রথম বারের মতো আর্টিকেল ৫ সক্রিয় হয়। এতে বলা হয়েছে, ন্যাটোর কোনো একটি দেশের ওপর সশস্ত্র হামলা সবগুলো দেশের ওপর হামলা বিবেচিত হবে এবং সব সদস্য দেশকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ৯/১১-এর হামলার জের ধরে আফগানিস্তানে হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক জোট, যা ২০ বছর ধরে চলে। প্রথম দিকে জোটসঙ্গীরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকলেও একে একে সবাই বিদায় নেয়। যুক্তরাষ্ট্রকেই একা লড়ে যেতে হয় তালেবানের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত তালেবানের হাতেই ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে হয় আফগানিস্তান থেকে।
পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি জার্মান ব্যাবসায়িক কমিউনিটির জন্য নতুন সুযোগ নিয়ে আসে। কমিউনিজমের পতনের পর পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের সুবর্ণ সুযোগ তাদের জন্য খুলে যায়। প্রাকৃতিক ও অন্যান্য সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলটি শীতল যুদ্ধ যুগেও ইউরোপে কাঁচামাল জুগিয়েছে। কমিউনিজম বিদায়ের পর ঐ দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসার সুযোগ পায় জার্মানি।
অন্যদিকে রুশ নেতৃবৃন্দ সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরও এর মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ফলে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তাদের মানসিকভাবে একাত্ম হতে পারেনি। সময়ের সঙ্গে এই দূরত্ব শুধু বেড়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একবার বলেই ফেলেছিলেন যে ‘কমিউনিজমের পতন ছিল বিংশ মতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।’ সোভিয়েত-পরবর্তী নব্বইয়ের দশকে রাশিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা সে দেশের অনেক মানুষকেই এ বিষয়ে ভাবিয়ে তুলেছিল যে সোভিয়েত যুগ সম্ভবত ভালো সময় ছিল। ২০০৭ সালে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে পুতিন বলেন, বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা মার্কিন আধিপত্য টিকিয়ে রাখারই একটি অবলম্বন মাত্র। লক্ষণীয়, এর পরের বছর রাশিয়া জর্জিয়ায় আগ্রাসন চালায়। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে। বছরখানেক পর সিরিয়ায় শাসক বাশার আল আসাদের পক্ষে সামরিক শক্তি নিয়ে দাঁড়ায়। এরপর ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করে।
লক্ষণীয়, রাশিয়া পশ্চিমের সঙ্গে সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের বিপরীত পথটিই বেছে নিয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো চেষ্টা করছে সেখানে উত্তেজনা যেন আর না ছড়ায়। এই উদ্দেশ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ফল কী হবে তা বলা যায় না। তবে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে রাশিয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতির চালচিত্র অনেকটাই বদলে দিয়েছে। রাশিয়া দেখিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি বা চুক্তি আসলে কতটা ভঙ্গুর। এমনকি ডলারের একচ্ছত্র রাজত্বকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রায় বৈদেশিক বাণিজ্য হতে পারে—এটা একসময় কেউ ভাবতেও পারেনি।