পয়লা বৈশাখ যেমনটি ছিল


বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম মাস। বাঙালির জীবনচক্রে ঘুরে আসে বার বার। বৈশাখের সাথে বাঙালির সংস্কৃতির প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ জড়িত। যদিও বাংলা বারো মাসের সাথে কোনো না কোনো সংস্কার জড়িয়ে আছে। দৈনন্দিন জীবনে এ সকল সংস্কার যতখানি না বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত তার চেয়ে বেশি জড়িত চিত্তবিনোদনের সাথে।

আমাদের জীবনে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি বহুমাত্রিক গুরুত্ব বহন করে। বাঙালির স্বকীয় সত্তার স্ফুরণ ঘটে বৈশাখের প্রথম দিনটিতে। যদিও জীবনাচরণের পরিবর্তন, ধর্মীয় চেতনা অনুপ্রবেশের অতিরঞ্জন, গ্রামীণ জনপদে নাগরিক জীবন তরঙ্গের অভিঘাত এবং কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকতার মাত্রাতিরিক্ত অনুপ্রবেশ বাঙালির জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তাছাড়া সংস্কৃতি লালনের নামে কিম্ভূতকিমাকার সংস্কৃতির চর্চা বৈশাখের রূপকে মলিন করে ফেলেছে।

পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে কেমন ছিল আমাদের জীবনের রূপ। কেমন ছিল বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে পয়লা বৈশাখের প্রভাব তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। আজকের দিনের মতো আগেকার দিনে মানুষের জীবন এত স্বচ্ছন্দ ছিল না, কিন্তু অভাব-অনটন আনন্দকে ম্লান করতে পারত না।



বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথেও পয়লা বৈশাখের নিবিড় সম্পর্ক আছে। আজকের দিনে যেমন করে রমনার বটমূলে গান গেয়ে পয়লা বৈশাখের রক্তিমাভারঞ্জিত সূর্যকে অভিনন্দন জানানো হয় তার মূলেও বাঙালি সংস্কৃতি সমূলে উত্পাটনে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের বিষয়টিই মুখ্য।

তবে স্বাধীন বাংলাদেশেও পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক অবিকৃত সংস্কৃতি যে শতভাগ রক্ষা করা গেছে তা কিন্তু নয়। পেছনের দিকে তাকিয়ে আজকের সাথে তুলনা করলেই প্রকৃত স্বরূপটি সামনে চলে আসবে।

পয়লা বৈশাখে গ্রামীণ জীবনের চিত্র :

প্রভাতের সূর্যশিখাকে অভিবাদন, পান্তাভাত পেঁয়াজ কাঁচামরিচ, নতুন জামা কেনা—এ সব কিছুই সামান্য ছিল বৈশাখী মেলার আয়োজনের কাছে। গ্রামের হাট-বাজার বা খালি ফসলের মাঠে বৈশাখী মেলা বসত। মেলাতে গিয়ে নাগরদোলায় চড়া, পুতুল নাচ দেখা, গজা-খাজা-মুড়িমুড়কি খাওয়ার আর্থিক প্রস্তুতি চলত আগে থেকেই।

মেলায় লোকজ জীবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে বসত দোকানিরা। মাটির নকশা করা হাঁড়ি পাতিল, মাটি দিয়ে তৈরি পুতুল, সানকি, পালকি, পালকিসমেত ঘোড়া, বরকনের পুতুল, বাঁশের এবং তারাইয়ের বাঁশি কেনার ধুম পড়ে যেত। তারপর বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি খাবার। আখের গুড়ের সাথে তিল, মুড়ি, খই, ভুট্টা দিয়ে নানারকম রসালো খাবার। তাছাড়া রসালো গুড়ের জিলাপি পদ্মপাতায় ভরে ছেলেমেয়েরা দল করে গাইত :

আমার মাইলেনি (মালিনী)

জিলাপি খাবে গো

অন্যেরা হাসতে হাসতে বলত—

জিলাপি খাব না

তোমার সনে যাব না।

মেলার একপ্রান্তে বিস্তৃত মাঠ জুড়ে হতো ঘোড়দৌড়। সেখানে যেমন হতো ঘোড়ার দৌড়ের প্রতিযোগিতা তেমনি দু আনা দশ পয়সার বিনিময়ে ঘোড়ায় চড়ার সুখও অনুভব করা যেত।

রঙিন শোভাযাত্রা :

পয়লা বৈশাখের আগমনের হাওয়া বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে গ্রামে গ্রামে গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি, এক্কা গাড়ি নানারঙে সাজানো হতো। গরু, মহিষ, ঘোড়ার গলায় মালা পরিয়ে সাজিয়ে রাখত।

প্রত্যেক গাড়িতে থাকত রঙের পাত্র। উঠতি বয়সীদের হাতে ফুলের মালা। নিজ নিজ এলাকায় ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা গানে গানে বলার জন্য সঙ্গে নিত ঢোল, করতাল, বেঞ্জু, জুড়ি, দোতারা, একতারা, কাঁসি-সহ নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র। প্রত্যেকের পায়ে বাঁধা থাকত ঘুঙুর।

সূর্য ওঠার সাথে সাথে দশ-পনেরটি গাড়ি বেরিয়ে পড়ত। এই বিচিত্র রঙিন শোভাযাত্রার শোভায় এবং নৃত্যবাদ্যের উল্লাসে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা উল্লসিত হতো।



আজকের দিনে পয়লা বৈশাখের গ্রামীণ মেলা টিকে থাকলেও জীবনধারার পরিবর্তনের দাপটে মেলার উপকরণ সামগ্রীতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আজকাল মেলায় গিয়ে ছোট্ট বাচ্চাটি মাটির পালকিঘোড়ায় যতটুকু আকৃষ্ট হয় তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ বোধ করে প্লাস্টিকের মোবাইল ফোনের প্রতি।

পান্তার নমুনা :

পান্তা ইলিশ কথাটি কে প্রথম তার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে জমিনে ছুড়ে ফেলেছে তা জানি না। তবে বাঙালি কখনোই পয়লা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খেত না। আর খাবেই কীভাবে? যে বাঙালির নুন আনতে পান্তা ফুরায় সে বাঙালি কিনা পান্তা ভাতের সাথে কষানো ইলিশের পেটি খাবে। যে বাঙালি—
‘পেটটি ভরে খায় না পেতে

বুকে ক’খান হাড়

সাক্ষী দিছে অনাহারে

কদিন গেছে তার।’

(আসমানী, জসীম উদ্দীন)

স্বয়ং মা লক্ষ্মীকে। সাক্ষাত্ দেখতে পেয়ে যে বাঙালি ঈশ্বরী পাটুনি বলে,

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’
—(ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, অন্নদামঙ্গল)

এই বাঙালি কিন পয়লা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খেয়ে উত্সবের সম্মান বাড়ায়। এমন কথা শুনলে আফ্রিকার গহিন অরণ্যের এক শিংওয়ালাও উচ্চহাস্যে ফেটে পড়বে।

মেয়েদের সাজসজ্জা :

পয়লা বৈশাখে শিশুকিশোরদের মাঝে রঙখেলা হতো। বয়ঃসন্ধি অতিক্রান্ত তরুণীরা এদিন সকাল বেলা স্নান করে টকটকে লালপেড়ে সাদাশাড়ি পরত। সারা গ্রাম হেসে হেসে ঘুরে বেড়াত। দিনশেষে তারা বাড়ির পেছনে কোনো এক বাঁশঝাড়ের ছায়ায় একত্রিত হয়ে বৈশাখের কাছে নিজেদের মনের গোপন বাসনা ব্যক্ত করত। তাদের মনের গোপন বাসনা কী সেটা না জানা গেলেও লোকজন বলাবলি করত সবাই মিলে সচ্চরিত্র, সুদর্শন বর প্রার্থনা করত।

বৈশাখের কাঠফাটা রোদে তখনকার দিনে ইঁদারা এবং পাতকুয়ায় পানি কমে যেত। তাই বৈশাখী সম্মিলিত স্নান হতো বিলে বা পুকুরে। সেখানে দেবররা ভাবিদের গালে কাদা লেপে দিত আর ভাবিরা পাতিলের তলার কালি লেপন করত দেবরদের গালে। কেউই বিরক্ত হতো না। কেননা, এমনটি বিশ্বাস ছিল যে, বছরের প্রথম দিনে হাসিখুশি এবং নির্বিবাদী না থাকলে সারা বছর তার জের টানতে হবে।
পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক কতিপয় লোকবিশ্বাস :

গ্রামীণ সমাজে পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে কতিপয় লোকবিশ্বাস প্রচলিত ছিল। এখনো গ্রামীণ সমাজে সে সব বিশ্বাস মানুষের মন থেকে বিলীন হয়ে যায়নি।

ক. পয়লা বৈশাখে ভোর বেলায় উঠে মা-বাবা এবং মুরব্বিদের সালাম করতে হয়। সালাম করলে সারা বছর সামাজিক সম্পর্ক অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে ঘনিষ্ঠ থাকে।

খ. সকাল বেলায় উঠে মাটির সানকিতে (অবশ্য আগেকার দিনে সানকি কেনার সামর্থ্যের বাইরে আর কোনো ধাতব থালাবাটি ব্যবহার করা বা কেনার মুরাদ খুব কম লোকেরই থাকত। বিত্তবানদের রান্না হতো পিতলের পাতিলে, খাওয়া হতো কাঁসার থালা-বাটিতে এবং পানি রাখত কলসি বা তামার কলসিতে) পান্তা নিয়ে কাঁচামরিচ কচলে নিত। সাথে কাঁচা পেঁয়াজে কামড় দিয়ে পরম তৃপ্তিতে খেত। পান্তা খাওয়াটা একটা লোকবিশ্বাসের ফল। লোকজন বিশ্বাস করত,
পান্তা ভাতের জল

তিনপুরুষের বল।

গ. পয়লা বৈশাখে বাকিতে বিকিকিনি করা হতো না। কেননা, সবাই বিশ্বাস করত বছরের পয়লা দিন বাকি বেচলে বা কিনলে সারাটা বছর বাকির ফাঁকিতেই। কেটে যাবে। তাই কেউ বাকি চাইতও না কেউ বাকি দিতও না।

ঘ. পয়লা বৈশাখে জোড়কলা হারাম :

এমনিতেই যমজ সবরি কলা খাওয়া সম্পর্কে এরূপ মনোভাব আছে যে, যমজ সবরি কলা খেলে যমজ বাচ্চা হয়। অবশ্য সারা বছরে এ বিশ্বাস পুরুষদের ক্ষেত্রে। আর পয়লা বৈশাখে এ প্রথা নারীপুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য হতো।

ঙ. তিতা ভক্ষণ :

বৈশাখের প্রথম দিনে তিন তিতা খাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। গরম ভাতের সাথে নাইল্যে অর্থাৎ পাট শাক খাওয়া। তাছাড়া নিম ও নিশিন্দার পাতা খেতে হতো। এর পেছনে টোটকার বিশ্বাস কার্যকর ছিল। কেননা, আগের দিনে গুটিবসন্ত মহামারি রূপে দেখা দিত। মানুষ চৈত্র-বৈশাখ মাসে আতঙ্কে থাকত। মানুষ যেমন বিশ্বাস করত—কার্তিক মাস কেটে গেলে এক বছর কলেরা থেকে মুক্ত হলো। তেমনি চৈত্র-বৈশাখ মাস পার করতে পারলে গুটিবসন্তের হাত থেকেও নিরাপদ হওয়া গেল।

চ. ভালোমন্দ খাওয়া :

গ্রামীণ সমাজে পয়লা বৈশাখে মানুষ সাধ্যমতো ভাল খাবার খাওয়ার চেষ্টা করত। তাদের মনে এরূপ বিশ্বাস ছিল যে, যদি বছরের প্রথমদিনে ভালো ভালো খাবার খাওয়া যায় তাহলে সারা বছরও ভালো খাবার জুটবে।



ছ. প্রহার এবং শাসনমুক্তদিন :

পয়লা বৈশাখে কোনো মা-বাবা তাদের সন্তান-সন্ততির গায়ে হাত তুলত না। এমন কি বকাঝকাও করত না। কেননা, তারা বিশ্বাস করত যে, বছরের প্রথম দিনে যদি সন্তানদের প্রহার করা হয় তাহলে সারা বছর তাদের মার এবং বকাঝকা খেতে খেতেই কেটে যাবে। এমনি আরো প্রচুর লোকবিশ্বাস মানুষের মাঝে চালু ছিল—যে সবের বিশদ বর্ণনা সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়।

পুরনো দিনের পুণ্যাহ বা হালখাতা :

পুণ্যাহর সাথে রাজা-বাদশাদের সম্পর্ক জড়িত। বাংলা সাল প্রচলনের ইতিহাসের সাথেও পুণ্যাহর সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। সে ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়। পুণ্যাহ এবং হালখাতাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির স্বরূপ অনুসন্ধানই এ আলোচনার মুখ্য বিষয়। জমিদারি আমলে বৈশাখের প্রথম দিনে পুণ্যাহ করা হতো। প্রজা সাধারণ বাকি কর পরিশোধ করত। জমিদাররাও প্রজাদের আপ্যায়ন করত। পয়লা বৈশাখে ক্ষেত্রবিশেষে প্রজাদের খাজনাও মওকুফ করা হতো। অনেকটা হাল আমলে কোনো জাতীয় দিবসে কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার মতো।

সেই রীতি ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ব্যবসা থাকলে বাকি কারবার অপরিহার্য। তাই সারা বছরের বাকি আদায় এবং ক্রেতাদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরির জন্য হালখাতা করা হয়। ব্যবসার খাতা হালনাগাদ করা বা নতুন খাতা খোলা হয়।

এ সময়ে পয়লা বৈশাখ :

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও বৈশাখের প্রথম দিনের মাঝে প্রকৃত লোকজ সংস্কৃতির যে প্রাণোচ্ছল প্রবাহ তা ক্রমেই চর্চার গণ্ডি ছেড়ে যাচ্ছে। পয়লা বৈশাখের গ্রামীণ মেলায় যে কথক দোতারা বাজিয়ে কিসসা গাইত সে দোতারার জায়গা বাঙালি সংস্কৃতিতে সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। দোহারের সারিন্দা, খোল, করতাল, জুড়ি, কাঁসি এখন প্রায় নির্বাসিত।

এই সময়ে বাংলাদেশে বৈশাখ আসে, পয়লা বৈশাখ আসে তবে তা উপভোগের মধ্যে আবহমান সংস্কৃতির স্বাদ নেই। তার জায়গায় কী আছে এবং কীভাবে চর্চিত হচ্ছে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখক: অধ্যক্ষ (অব.), কাঁচকুড়া ডিগ্রি কলেজ, উত্তরা, ঢাকা





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/639792/%E0%A6%AA%E0%A7%9F%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A7%88%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%96-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%9B%E0%A6%BF%E0%A6%B2

Sponsors

spot_img

Latest

Zero-Knowledge Proof Explained – DailyCoin

Have you ever felt the immense frustration of knowing secret information but being unable to ‘prove’ it without sharing it? Then zero-knowledge proofs...

State Dept. should’ve done more to prepare for worst-case scenario of Afghanistan withdrawal, Blinken says

The State Department declined to comment on the private workforce engagement. During his opening remarks, Blinken highlighted five lessons the department gleaned during the...

When Leaders Struggle with Collaboration

A client of Luis’s, let’s call him Charlie, a senior executive reporting directly to the CEO, was recently given feedback that despite his...

Ethereum Price To Remain Sluggish Before It Attempts A Rally

The Ethereum price has moved in the same direction as the broader market. In the last 24 hours, Ethereum has moved up by...