পাপমুক্তি আর আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনায় পবিত্র মক্কা নগরীর অদূরে ‘উকুফে আরাফা’য় অবস্থানের মধ্য দিয়ে গতকাল পবিত্র হজ পালন করেছেন গোটা দুনিয়া থেকে আগত ২৬ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান। আরাফাতের পাহাড়ঘেরা ময়দান ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস মুখর ও প্রকম্পিত হতে থাকে আবেগাপ্লুত বেশুমার কণ্ঠের ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ তালবিয়ায়। জাবালে রহমত সাদা আর সাদায় একাকার। আদিগন্ত মরু প্রান্তর এক অলৌকিক পুণ্যময়তায় অধিকার করে রাখে। এক অপার্থিব আবহ রচিত হয় পুরো ময়দানে। সবার পরনে সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র। সবারই দিনহীন বেশ। নেই আশরাফ-আতরাফ বিভেদের অচলায়তন। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ, রহমতপ্রাপ্তি ও নিজের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে অশ্রুসিক্ত ফরিয়াদ জানান সমবেত মুসলমানেরা। একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হন, কুশল বিনিময় করেন। বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যেরও অবতারণা হয় গতকাল সেই ময়দানে। বিশ্ব মুসলমানের মহাসম্মিলনের দিন।
গতকাল দুপুরে সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর মসজিদে নামিরা থেকে খুতবা প্রদান করেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য শায়খ ড. ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সায়িদ। আরাফাতের ময়দানে পবিত্র হজের খুতবায় বিশ্ব উম্মাহর মঙ্গল কামনাসহ ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছে।
খুতবায় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মঙ্গল কামনাসহ ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছে। ইসলামের রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে ভাই ভাই হয়ে তাওহিদের পথে অটল থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। শায়খ ড. ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সায়িদ হজের খুতবায় বলেন, শয়তানের পথ পরিহার করতে হবে। কেননা, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।
জীবনের সব অঙ্গনে ইহসানের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দেওয়ার উজ্জ্বল দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় খুতবায়। সবাই এক আল্লাহর বান্দা। আরব-অনারব ভেদাভেদ নেই, কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, ধনী-গরিব পার্থক্য নেই। আল্লাহ তাআলার কাছে তাকওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
খুতবায় মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়েছে। মুসলিমদের জন্য করণীয় বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয় হজের খুতবায়। এক আল্লাহর ইবাদত তথা নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত নিয়ে কোরআনের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়। আহ্বান জানানো হয় পরস্পর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষার।
হজের খুতবায় শায়খ ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সায়িদ আরো বলেন, আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ (স.)কে শেষ নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তার কাছে নাজিলকৃত পবিত্র কোরআনে নামাজ, রোজ, জাকাত ও হজ ফরজ করেছেন। মুসলমানদের কাছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। তিনি এক, তার কোনো অংশীদার নেই। খুতবায় বলা হয়, আল্লাহ তাআলা মানুষকে শুধু ইবাদতের জন্য তৈরি করেছেন। আল্লাহ তাআলার এই নির্দেশ অনুসারে মানুষকে নিজের অন্তর পরিশুদ্ধ করতে বলেছেন এবং তাকওয়া অবলম্বন করতে বলেছেন।
খুতবায় আরো বলা হয়, আল্লাহ তাআলা বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলাম ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। আল্লাহ তাআলা বাবা-মায়ের পর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন, যে বান্দা নিজের ওপর জুলুম করে তার জন্য তওবার দরজা খোলা রয়েছে। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ক্ষমা করতে পারে না।
খুতবায় মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে বলা হয়, হে মানব সম্প্রদায়, আল্লাহ তাআলা তোমাদের ন্যায় ও ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছেন। মানবজাতির জন্য এমন বিধিবিধান তিনি পাঠিয়েছেন, যার মাধ্যমে মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। ন্যায়বিচার করতে হবে। কেননা এটি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সবকিছু ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। আমাদের আচরণে তা ফুটিয়ে তুলতে হবে।
প্রসঙ্গত, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মেহমানরা গতকাল সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে কেউ গাড়িতে, কেউ পায়ে হেঁটে আরাফাতের ময়দানের দিকে রওনা হন। সৌদি কর্তৃপক্ষ হাজিদের আরাফাত ময়দানে আনার জন্য বিপুলসংখ্যক গাড়ির ব্যবস্থা করেন। ইহরাম পরা মুসলিমদের এই স্রোত যতই আরাফাতের নিকটবর্তী হতে থাকে, ততই তারা ভাবাবেগে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তাদের মানস চোখে ভেসে ওঠে সেই আরাফাত ময়দানের ছবি, যেখানে ১৪০০ বছর আগে আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বিদায় ভাষণ দিয়েছিলেন।
বাংলাসহ ২০ ভাষায় হজের খুতবা
এবার ২০টি ভাষায় হজের খুতবার অনুবাদ সম্প্রচার করা হয়েছে। ভাষাগুলো হলো—ইংরেজি, ফরাসি, ফার্সি, উর্দু, হাউসা, রাশিয়ান, তুর্কি, বাংলা, চীনা, মালয়, সোয়াহিলি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, আমহারিক, জার্মান, সুইডিশ, ইতালীয়, মালয়ালম, বসনিয়ান ও ফিলিপিনো।
টানা চতুর্থবারের মতো বাংলা ভাষায় হজের খুতবা শোনা যায়। এবার খুতবার বাংলা অনুবাদ করছেন আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান ও ড. খলীলুর রহমান। তাদের সঙ্গে আরো ছিলেন মুবিনুর রহমান ফারুক ও নাজমুস সাকিব। গত ১৪৩৯ হিজরি মোতাবেক ২০১৮ সালে জেনারেল প্রেসিডেন্সি বিভাগের তত্ত্বাবধানে পাঁচটি ভাষায় আরাফাতের খুতবা অনুবাদ প্রকল্প যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালে বাংলাসহ মোট ১০টি ভাষায় খুতবার অনুবাদ করা হয়। পরের বছর ১৪টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে হজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র ১০ হাজার মানুষ; ২০২১ সালে ৫৯ হাজার। আর গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ১০ লাখ। আর চলতি বছর সর্বোচ্চ ২৬ লাখ মুসল্লি হজ করলেন।