দেশের উচ্চশিক্ষার টিচিং-লার্নিং ও গবেষণার গুণমান উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য সামগ্রিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা ও ফলাফল উন্নত করার লক্ষ্যে হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (হেকেপ) নেওয়া হয়েছিল। ১ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৯ সাল থেকে ১০ বছর পর্যন্ত এটি চলে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষণা সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা, গবেষণা প্রকল্পের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কোলাবরেশন, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতকে উদ্ভাবনের অগ্রভাগে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। তবে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টে অদক্ষতা ও মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় টেকসই উপায়ে প্রকল্পটি পরিচালিত হয়নি। এতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যাহত হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথ্য সহজে পাওয়ার জন্য ওয়েবভিত্তিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনা তথ্য সিস্টেম, বিশ্বখ্যাত ইবুক, জার্নাল সহজে ও সাশ্রয়ী উপায়ে পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইউজিসি ডিজিটাল লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেলফ অ্যাসেসমেন্ট ত্বরান্বিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক গুণমান নিশ্চিতকরণ সেল স্থাপন করা হলেও এগুলোর কার্যকারিতা বর্তমানে প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রকল্প শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএসইডি) তাদের প্রতিবেদন এ তথ্যই তুলে ধরেছে। গত মাসে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রকল্পের আওতায় প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতকরণের জন্য ৬৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এজন্য জনবলও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায়, কিংবা স্থবির হয়ে যায় কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স কার্যক্রম। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাউবি) ২০১৭ সালে এই সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটার কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।
প্রকল্পের অধীনে বিডিরেনের নেটওয়ার্কের আওতায় দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি সুবিধা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ইন্টারনেটের গতি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা। বিডিরেনের আওতায় আইটি অবকাঠামোর টেকসইকরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্বখ্যাত টাইমস হায়ার এডুকেশন ২০২৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং অনুযায়ী, বিশ্বের ১ হাজার ৭৯৯টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের মোট পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি, বুয়েট, কুয়েট, বাকৃবি ও নর্থ-সাউথ) জায়গা করে নিতে পেরেছে, যা ২০২২ সালে ছিল দুটি (ঢাবি ও বুয়েট)। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে যথাক্রমে—৭৫টি ও ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে।
এ বিষয়ে আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ভারত ও পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমবর্ধমান উন্নতি হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা লক্ষ করা যায়নি। অথচ হেকেপ প্রকল্পের ফান্ডের অর্থ টিচিং-লার্নিং ও গবেষণায় ব্যবহারের ফলে এর প্রভাব হিসেবে তা হওয়া স্বাভাবিক ছিল।
প্রকল্পের আওতায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব তৈরি করা হয়। প্রকল্প শেষে দেখা যায়, যন্ত্রপাতি বা উপকরণের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্টস বিভাগের এনিমেল রিসার্চ কেন্দ্রে স্পার্ম কালেকশনের জন্য গরুর শেড করা হলেও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অংশ খালি রয়েছে। কিছুসংখ্যাক উপকরণ অল্প সময়ের ব্যবধানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। হাই-পারফরম্যান্স ইক্যুইপমেন্টের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রায় একই অবস্থা।
আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো বিভাগে প্রয়োজনের তুলনায় কম গবেষণার উপকরণ, ল্যাব দেওয়া হয়। আবার কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগে প্রয়োজনের বেশি গবেষণার উপকরণ, ল্যাব দেওয়া হয়েছে। এসব ল্যাব ও উপকরণ ব্যয়বহুল হওয়ায় তা এককভাবে কোনো বিভাগের পক্ষে এর ব্যয়ভার বা রক্ষণাবেক্ষণ পরিচালন সম্ভব নয় বলে মনে করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। থ্রিডি প্রিন্টারসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতি অল্পসময়েই অকেজো হয়ে গেছে।
আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, প্রকল্পের আওতায় প্রদানকৃত গবেষণা উপকরণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অকেজো কিংবা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, উপকরণ গুণমান ভালো হলে দীর্ঘ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইক্যুইপমেন্টের একটি অংশ অকেজো রয়েছে। ১৭টি যানবাহনের (প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস) মধ্যে ইউজিসি ব্যবহৃত পাঁচটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্প অফিসের নথিপত্র বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সংগ্রহ করতে পারেনি। বাস্তবায়নকারী সংস্থার তথ্যমতে, এ প্রকল্পের কোনো প্রকার নথিপত্র তাদের হাতে নেই। ফলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়সংক্রান্ত নথি, উপ-প্রকল্পের সমাপ্ত প্রতিবেদনসহ অন্য কোনো প্রকার নথিপত্র বাস্তবায়নকারী সংস্থা সরবরাহ করতে পারেনি। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাস্তবায়নকারী সংস্থার অদক্ষতা, অসক্ষমতা ও অবহেলা পরিলক্ষিত হয়েছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রকল্পে ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি লিংকেজ ইনোভেশন ফান্ডের আওতায় ১০টি উপপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। উপপ্রকল্পের ১০টি গবেষণা কার্যক্রমের আউটপুট হিসেবে সাতটির জন্য দেশে ও বিদেশে দুটি পেটেন্ট আবেদন করা হলেও একটিও চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়নি। এই এক পিঠ প্রকল্পের জন্য দায়িত্ব পালন করেছেন ৯ জন প্রকল্প পরিচালক। ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ফেরদৌস জামান বলেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য গঠিন সেল কাজ করছে। কোথাও বন্ধ হয়নি। আর গাড়ি পরিত্যক্ত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পের শুরুতে গাড়ি ক্রয় ও রেজিস্ট্রেশন করা হয়। সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী নয়। তবে এর মধ্যে একটি গাড়ি সংস্কার করে ব্যবহার করা হচ্ছে।