বড়দিন উপলক্ষ্যে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ২ হাজার দুস্থ ও বিধবা নারীর শ্রমে তৈরি কচুরিপানার সান্তা ক্লজ, বাহারি উপহার ও খেলনাসামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করে সুনামের সঙ্গে অর্জন করছে বৈদেশিক মুদ্রা। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘প্রকৃতির’ উদ্যোগে আগৈলঝাড়া উপজেলার পাঁচটি কেন্দ্র এলাকার প্রায় ২ হাজার দুস্থ ও বিধবা নারী পরিত্যক্ত ডোবা ও পুকুরের কচুরিপানা দিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত কাগজ তৈরি করে ঐ কাগজ দিয়ে তৈরি করছেন যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সান্তা ক্লজ, ক্রিসমাস ট্রি গির্জা ও বাড়ি সাজানোর পণ্যসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য নানা উপহারসামগ্রী।
উপজেলার জোবারপার এন্টারপ্রাইজে কর্মরত ঐ গ্রামের বাসিন্দা মণিবালা (৪৮) জানান, কচুরিপানা আর বড়দিন তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মণিবালা কচুরিপানার কাগজ দিয়ে তৈরি করা বড়দিনের সান্তা ক্লজসহ বিভিন্ন উপহারসামগ্রী তৈরির সুনিপুণ কারিগরদের একজন। মণিবালার মতো ঐ এলাকার অসহায় ও দুস্থ নারীরা আগৈলঝাড়ার পাঁচটি কেন্দ্রে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।
তিনি আরো বলেন, অভাবের সংসারে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচেছিলাম। আজ তিনি ও তার সহকর্মীরা তিন বেলা ভাত খেতে পারছেন। মণিবালার আরেক সহকর্মী বিধবা বীণা হালদার (৫০) ও বিধবা শিউলী বেগম (৪৭) বলেন, ‘আমরা যেসব জিনিস তৈরি করছি, সেগুলো দিয়ে দীর্ঘদিন থেকে দেশ-বিদেশের খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়ের লোকজন শুভ বড়দিন পালন করে আসছেন । প্রতিদিন চলেছে। একজন নারী শ্রমিক উৎপাদিত কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা আয় করছেন।
জোবার পাড় এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার পাপড়ী মণ্ডল জানান, বর্তমানে প্রকল্পের অধিকাংশ কর্মই হচ্ছেন স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা কিংবা অসহায় ও দুস্থ। প্রোডাক্ট ডিজাইনার খোকন সমদ্দার জানান, উপজেলার জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজ, কালুরপাড়ের বিবর্তন, বড়মগরার কেয়া পাম হ্যান্ডিক্রাফটস, নগরবাড়ীর চ্যারিটি ফাউন্ডেশন ও বাগধা এন্টারপ্রাইজে প্রতি বছরই নতুন নতুন গিফট আইটেমের কাজ করা হয়। এখানে ৪ হাজারের ওপর আইটেম তৈরি করা হয়।
আগৈলঝাড়ার বিবর্তন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে কচুরিপানাকে ঘিরে এমসিসি (মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি) আওতায় এলাকায় গড়ে ওঠে জোবারপাড় এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় এলাকার অসহায় নারীরা শুধু ডোবা ও মজা পুকুর থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করেন। কচুরিপানার সঙ্গে পাট, পরিত্যক্ত কাগজ ও সিল্ক কাপড় দিয়ে মন্ড তৈরি করা হয়। এরপর তাতে রং দিয়ে রোদে শুকানোর পর তৈরি হয় কাগজ। এভাবে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে ৩ হাজার পিস কচুরিপানার কাগজ। সেই কাগজ দিয়ে তৈরি করা হয় হস্তজাত উপহারসামগ্রী। ঐ উপহারসামগ্রীতে বিভিন্ন ধরনের কাঁচা ফুলও ব্যবহার করা হয় । অল্প সময়ের মধ্যে অসহায় নারীদের হাতে তৈরি পণ্য বিদেশে বাজার পেয়ে যায় । একই বছর উপজেলার বাগধা এলাকায় বাগধা এন্টারপ্রাইজ নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়। এ দুটি প্রকল্পের সাফল্যের পর ১৯৮৭ সালে গড়ে ওঠে কেয়াপাম হ্যান্ডিক্রাফট নামের আরো একটি প্রতিষ্ঠান। এরপর ১৯৯৩ সালে আগৈলঝাড়ায় বিবর্তন নামে আরো একটি প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে।
তিনি জানান, কচুরিপানার কাগজ দিয়ে তৈরি তাদের উপহারসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে কানাডা, ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। প্রতি বছরই ঐ সব দেশে এ উপহারসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে বড়দিনের উৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এর চাহিদা ক্রমেই বেড়ে ঐ সংস্থার মাধ্যমে শৌখিন এসব খেলনা ও উপহারসামগ্রী ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানির মাধ্যমে আসছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। দুস্থ নারীদের তৈরি করা কচুরিপানার শৌখিন উপহারসামগ্রী সর্বত্র প্রশংসা কুড়িয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রকৃতি বাংলাদেশ’-এর মাদার প্রকল্প ‘এমসিসি আমেরিকা’র কান্ট্রি প্রতিনিধি মি. জর্জ জানান, ১৯৮৭ সালে আগৈলঝাড়ায় কেয়াপাম হ্যান্ডিক্রাফটস মাত্র সাত জন নারীকর্ম নিয়ে ৬ লাখ ডলার মূল্যের রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করে। বর্তমানে এখানকার হস্তজাত শিল্প এখন ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ২০ লাখেরও বেশি মার্কিন ডলার আয় করছে।