১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বাঙালির জাতীয় জীবনে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে এই কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের যথাযথ ইতিহাস ও তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্ববহ। কেননা এ কথা অনস্বীকার্য যে, তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমের মহিমায় জাগ্রত করতে হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতাসংগ্রামের যথাযথ ইতিহাস এবং যুদ্ধকালীন প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঠিক তথ্য অনুধাবন অতিব প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে দেশের প্রতিটি তরুণকে লক্ষ্যদল হিসেবে নিয়ে তাদের মন ও মননে গ্রোথিত করতে হবে স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাস।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সারা দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে যে বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তি লাভ করেছিল; তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণকে সেই বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। স্বাধীনতাকামী, দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই দেশের জনগণকে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের অপারেশন সার্চলাইট কর্মসূচির আওতায় ঢাকায় নিরীহ জনগণের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে হত্যা করা শুরু করে এবং মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেওলিয়ায় পরিণত করার জন্য দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে নির্মমভাবে হত্যা করে। প্রথম ও সব থেকে বেশি আঘাত আসে শিক্ষাবিদদের ওপর। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ওপর চালানো হয় নির্মম হত্যাকাণ্ড। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা অদ্যাবধি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, ১১১১ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা পাওয়া যায়, যাদের বেশির ভাগই (৯৯১ জন) শিক্ষাবিদ।
এই বুদ্ধিজীবীদের কৌশলে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, তাদের ওপর চালানো হতো নির্মম শারীরিক নির্যাতন এবং বেয়নেটের আঘাতে তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করা হতো। এর প্রমাণ মিলে রায়েরবাজার ও মিরপুরের জলাভূমি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত গণকবরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গণকবরসমূহে। ডোবানালা, নিচু জমি ও ইটের পাঁজার মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বহুসংখ্যক মৃতদেহ পাওয়া যায়, কারো কারো চোখ বাঁধা ছিল কালোকাপড়ে, কারো হাত ছিল পেছনে বাঁধা, কারো বুকে, কারো মাথায়, কারো পিঠে ছিল বুলেটের আঘাত এবং সারা দেহে বেয়নেটের ক্ষতচিহ্ন।
তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং এদেশীয় দোসর ষড়যন্ত্রকারীরা ভালো করেই জানত, এই শহিদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপস না করা, দেশাত্মবোধকে বেগবান করা এবং ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য দেওয়া। এই চেতনাবোধে জাগ্রত হয়ে, এই শহিদ বুদ্ধিজীবীরা বন্দুকের কাছে পরাস্ত হতে দেননি নিজেদের আদর্শকে। এমনকি নিজের আত্মীয়স্বজন, পরিবার- পরিজনের কথা না ভেবে, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও নিজের দায়িত্ববোধ ও আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে দেশের সঙ্গে, দেশের মানুষের সঙ্গে অন্যায় হতে না দেওয়ার জন্য মৃত্যুকে আপন করে নিতে পিছপা হননি। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা ছিল এই শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ ও চেতনা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির সঙ্গে আপস না করে, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনা ও আদর্শকে বুকে লালন করে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত করতে তৎকালীন ও তত্পরবর্তী তরুণ সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান তরুণ সমাজ দেশ ও জাতির আগামীর ভবিষ্যৎ ও দেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দক্ষ কারিগর। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে তরুণ বয়সের জনসংখ্যা বিগত সময়ের থেকে সবচেয়ে বেশি। এই তারুণ্য শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের দেশ বিশ্বের কাছে হয়ে উঠবে রোলমডেল। এজন্য নীতিনির্ধারণী মহলের সঠিক পরিকল্পনার পাশাপাশি আমাদের সমাজের তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ববোধ ও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় চেতনা ও পরিশ্রম করার মানসিকতা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই বিষয়টি এখনো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে না। যদিও বিগত এক দশকে তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমের মহিমায় জাগ্রত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের মন ও মননে শক্ত মূল্যবোধের গোড়াপত্তন প্রত্যাশার থেকে পিছিয়ে আছে। যেখানে প্রয়োজন স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহে আত্মত্যাগের মহিমা যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, মা-বোনের সম্ভ্রম ও অত্যাচারের ইতিহাস, সর্বোপরি জাতির মেরুদণ্ড বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ও নৃশংসতার ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা। যার সঠিক প্রভাবে তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। ফলে এই তরুণ প্রজন্মই দেশ ও জাতির উন্নয়ন অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পিছপা হবে না। তবে এ কথা ঠিক, সময় থাকতেই এই তরুণ প্রজন্মকে চেতনায় ফিরিয়ে আনতে হবে। যার দায় আমাদের সবার।
আর সংগত কারণেই এই তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশের সামগ্রিক কল্যাণে নিজেদের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করতে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনা ও আদর্শ হতে পারে দিকনির্দেশক, পথ-পরিদর্শকের। সব শহিদের আত্মত্যাগ, আদর্শ ও দেশাত্মবোধ হয়ে উঠবে তরুণ প্রজন্মের আদর্শ এবং শহিদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনার আলো ছড়িয়ে পড়বে দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনা ও আদর্শ আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করুক, সেই দায়পূরণের প্রতিশ্রুতি হোক আমাদের প্রত্যয়।
লেখক : উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়