১০ বছর আগে সাভারে ধসে পড়েছিল রানা প্লাজা নামের আটতলা ভবনটি। সেই ঘটনায় কয়েক হাজার লোক হতাহত হয়। যাদের বেশির ভাগই পোশাকশ্রমিক। এই শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে মামলার বিচার কাজ বন্ধ ছিল প্রায় ছয় বছর। বিচার বিলম্বে এখন অনেক সাক্ষীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। এই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে প্রায় ৬০০ জনকে। এসব সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে কবে নাগাদ মামলার বিচার শেষ করা সম্ভব হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা। এদিকে বিচার এবং পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন শ্রমিকরা। তারা বলছেন, আমরা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাইনি। আর হত্যা মামলার আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা নামের আটতলা ভবনটি ধসে পড়ে। এই ধসে পরার ঘটনায় ভবনের নিচে আটকা পড়ে হাজার হাজার মানুষ। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন—আইএলও-এর হিসাব মতে ঐ ঘটনায় ১ হাজার ১৩২ জন নিহত হন। নিহতের মধ্যে বেশির ভাগই পোশাক শ্রমিক। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় প্রায় আড়াই হাজার জনকে। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে অনেকেই আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। যারা এই মামলার অন্যতম সাক্ষী।
ভবন ধসে মানুষ হতাহতের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডি ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি) আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এই অভিযোগ গঠন চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যান সাত-আট জন আসামি। তাদের আবেদনে মামলার বিচার কাজ স্থগিত করে দেয় উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে বিচার কাজ বন্ধ থাকে প্রায় ছয় বছর। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় হাইকোর্ট। শুরু হয় মামলার বিচারকাজ। এখন মামলাটির বিচারকাজ চলমান। আগামী ১৫ মে এই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট বিমল সমাদ্দার ইত্তেফাককে বলেন, সাক্ষীদের হাজির করতে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে সমন ছাড়াও জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে। কিন্তু সাক্ষীদের ঠিকানা পরিবর্তন হওয়ায় অনেক সাক্ষীকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হদিস নেই এমন সাক্ষীর সংখ্যা ৩০ জনের মতো। এছাড়া আহত শ্রমিকদের মধ্যে যাদের সাক্ষী করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যারা আসছেন তাদের সাক্ষ্য এখন নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, মামলা প্রমাণের জন্য আমরা সব সাক্ষীকেই আনার চেষ্টা করব। যারা আসবে তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হবে। এ কারণে কবে নাগাদ এই মামলার বিচার শেষ হবে সেটা বলা যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেছে পুলিশ। এছাড়া ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আরেকটি মামলা করে। এই দুটি মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি।
এদিকে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্তিতে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন নিহতদের স্বজন, আহত শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। প্রতি বছরের মতো এবারও সোমবার সকাল থেকেই বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এবং ব্যক্তিগতভাবে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনের নির্মিত অস্থায়ী শহিদ বেদিতে এ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দিনটি উপলক্ষ্যে প্রতিবাদী সমাবেশ, স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, দোষীদের শাস্তির দাবি এবং শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করা হয় রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির হতাহতদের। সকাল থেকে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি, রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের সংগঠন রানা প্লাজা সার্ভাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম, বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলেন, ২৪ এপ্রিলকে শোক দিবস ঘোষণা করে হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, ২৪ এপ্রিল কে শোক দিবস ঘোষণা, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, শ্রমিক হত্যার বিচার, শ্রমিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং সোহেল রানাসহ দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে হবে।
শ্রদ্ধা জানাতে আসা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা জানান, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক শিল্পে আমূল পরিবর্তন এলেও এখানে ভবন ধসে আহত, পঙ্গু, শ্রমিকদের জীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। বিছানায় শুয়ে এখনো বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছেন তারা।
রানা প্লাজার আহত শ্রমিক আলেয়া বেগম বলেন, ‘মেরুদণ্ড ও পায়ে আঘাত পাওয়ায় আমি কোনো কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্টে থাকলেও রানা প্লাজা ধসের এতদিন হয়ে গেছে কেউ আমাদের কোনো খবর নেয় নাই। আমরা কারো কাছে ভিক্ষা চাই না। আমাদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হোক।’
রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক হাসিনা আক্তার বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসে আমি পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। নামমাত্র অনুদান ছাড়া আমি ক্ষতিপূরণ পাইনি, বিচারও পাইনি। আমরা ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’
গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আক্তার বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই আমরা বিভিন্ন দাবি তুলেছি। এই ১০ বছরে আমাদের দাবিগুলো পূরণ হলো না। ১০ বছর পরে এসেও আমরা একই দাবি জানাচ্ছি। আমরা আশা করি, আগামী বছর আর এসব দাবি নিয়ে আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতে হবে না। তার আগেই সবগুলো দাবি পূরণ করা হবে।
এর আগে ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ী শহিদ বেদিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিহত শ্রমিকদের স্মরণ করা হয়। এ সময় রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত শ্রমিক ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য চার দফা দাবি জানান বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। দাবিগুলো হলো, শ্রমিকের এক জীবনের আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ, রানা প্লাজার জমিটি বাজেয়াপ্ত করে হতাহত শ্রমিকদের স্থায়ী পুনর্বাসন, বিনা মূল্যে আজীবন চিকিৎসা ও রানা প্লাজার মালিকের দ্রুত বিচার।