বর্তমান সরকারের একজন সচিব আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। আর সরকারের যুগ্ম-সচিব বিদ্যোত্সাহী সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তবুও সেখানে নানা অনিয়ম ভর করেছে। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে সরকারের বিধি মানা হচ্ছে না। সরকারি নির্দেশনাও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া গভর্নিং বডিতে রয়েছেন একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি। যাদের নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনা চলছে। যাতে মর্যাদা হারাচ্ছে রাজধানীর মতিঝিলের নামি এই প্রতিষ্ঠানটি।
গভর্নিং বডির এক সদস্যদের বিরুদ্ধে আরেক সদস্যকে হত্যার মামলাও চলছে। অন্য এক সদস্যের বিরুদ্ধে কোচিংবাণিজ্য পরিচালনার অভিযোগও জমা হয়েছে বিভিন্ন দপ্তরে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গভর্নিং বডির এক সদস্যের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটিরই এক ছাত্রীকে বিয়ের বিষয়ে মামলা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক এই প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, ‘আমরা লজ্জার মধ্যে আছি। যেখানে গভর্নিং বডিই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে, সেখানে গভর্নিং বডির মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।’
প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়মের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে উচ্চ আদালতও। চলতি সপ্তাহে এক শুনানিতে উচ্চ আদালত মন্তব্য করেছেন, রাজধানীর মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। তাই এ প্রতিষ্ঠানকে সরকারি খাতে নেওয়া উচিত।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে তাকে হত্যা করা হয়। এই মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি বর্তমানে গভর্নিং বডির সদস্য গোলাম আশরাফ তালুকদার। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও। চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় সম্প্রতি তাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও গোলাম আশরাফ তালুকদারের নাম এখনো গভর্নিং বডির সদস্য তালিকায় রয়েছে।
শাহাদাত হোসেন ঢালী প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির প্রাথমিক শাখার সদস্য। তিনি আইডিয়াল একাডেমিক কোচিং সেন্টারের মালিকও। প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের প্রভাবিত করে তার পরিচালিত কোচিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির অন্য সদস্যদের নিয়ে কোচিং সেন্টারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তিনি। এই সদস্যের বিরুদ্ধে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ জমা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিতে সর্বশেষ পেরেক ঠুকেছেন গভর্নিং বডির দাতা সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ। সম্প্রতি ‘প্রলোভনের মাধ্যমে’ প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রীকে বিয়ে করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। ঐ ছাত্রীর বাবা এখন তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছাত্রীর বাবা উচ্চ আদালতে মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মামলায় ছাত্রীর বাবা বলেন, তার মেয়ে মতিঝিল আইডিয়ালের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। আসামি মুশতাক বিভিন্ন অজুহাতে কলেজে আসতেন এবং ভুক্তভোগীকে ক্লাস থেকে অধ্যক্ষের কক্ষে ডেকে আনতেন। খোঁজখবর নেওয়ার নামে তিনি ভুক্তভোগীকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতেন। কিছু দিন পর আসামি মুশতাক ভুক্তভোগীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কুপ্রস্তাব দেন। এতে রাজি না হওয়ায় ভুক্তভোগীকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে এবং তাকে ও তার পরিবারকে ঢাকা ছাড়া করবে বলে হুমকি দেন।
এই মামলায় ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে কলেজের অধ্যক্ষকে। ছাত্রীর বাবা বলেন, এ রকম আচরণের বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু অধ্যক্ষ কোনো সহযোগিতা করেননি, বরং আসামি মুশতাককে অনৈতিক সাহায্য করেন। বাদী উপায় না পেয়ে গত ১২ জুন ভুক্তভোগীকে ঠাকুরগাঁওয়ের বাড়িতে নিয়ে গেলে আসামি মুশতাক তার লোকজন দিয়ে ভিকটিমকে অপহরণ করে নিয়ে যান। এরপর বাদী জানতে পারেন আসামি ভিকটিমকে একেক দিন একেক স্থানে রেখে অনৈতিক কাজে বাধ্য করেছে এবং যৌন নিপীড়ন করছে। এই ঘটনায় আদালত অধ্যক্ষকে আগাম জামিন দিলেও জামিন পাননি মুশতাক আহমেদ। জানা যায়, শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর আর গভর্নিং বডির সদস্যের বয়স ৬০ বছর।
জিয়াউল কবীর নামে এক অভিভাবক বলেন, যে প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির এত সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ। সেখানে ভাবমূর্তি আর কী থাকবে। এর প্রধান দায় নিতে হবে গভর্নিং বডিকে।
প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক শিক্ষকই কথা বলেছেন। কিন্তু কেউ নাম পরিচয় প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছেন না। এছাড়া আরও অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে সরকারের বিধি মানা হয় না। ইচ্ছেমতো শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ হয়। একজন সচিব সভাপতি থাকার কারণে গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না—এমনটাই মনে করেন অভিভাবকরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খন্দকার মুশতাকের গভর্নিং বডির সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছে। তবে গোলাম আশরাফ তালুকদারের সদস্য বাতিলের বিষয়ে এখনো কোনো প্রস্তাব আসেনি।