বিরোধিতা বন্ধে ক্যাম্পে আরসার আগুন-সন্ত্রাস!


নিজ দেশে নিপীড়নের পর বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ ক্যাম্পে আশ্রয় পেয়েছে এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা। সেসব ক্যাম্পেই মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী দুর্বৃত্ত সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি’র (আরসা) প্রেতাত্মা হয়ে বিপথগামী কিছু রোহিঙ্গা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশকিছু ক্যাম্পে তারা নির্বিঘ্নে অপরাধকাণ্ড ঘটালেও উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে প্রতিরোধের মুখে পড়েছে বার বার। এ কারণে আধিপত্য বিস্তার ও নিজেদের সম্পর্কে ভীতি সঞ্চার করতে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা ঘটিয়েছে কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা, এমনটি মনে করছে সাধারণ রোহিঙ্গারা।

তাদের দেওয়া উদ্দেশ্যমূলক অগ্নিকাণ্ডে দুই হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়েছে। এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারেনি অধিকাংশ রোহিঙ্গা। তবে আইওএমসহ একাধিক সাহায্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে বাঁশ-বেড়া ও তাবু দিয়ে ঘর তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ডা. সামশুদ্দৌজা নয়ন।



এদিকে, ক্ষতিগ্রস্তদের একজন বৃদ্ধা রহিমা খাতুন জানান, শুধু এক স্থানে নয়, একযোগে অন্তত পাঁচের অধিক জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয় কথিত সন্ত্রাসীরা। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদেরও ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় বাধ্য করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পের এক ব্লক মাঝি জানান, আরসার সদস্যরা অন্যান্য ক্যাম্পে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও ক্যাম্প-১১ ও আশপাশের ক্যাম্প ও ব্লকে বাধা পেয়ে আধিপত্য বিস্তারে ব্যর্থ হচ্ছিল। হয়তো এ কারণে তারা ১১ নম্বর ক্যাম্পে আগুন লাগিয়ে জাত-ভাইদের এভাবে ভোগান্তিতে ফেলেছে।

তার এ শঙ্কার সত্যতা মিলেছে ইউটিউবে কথিত আরসা নেতার উস্কানিমূলক অডিওতে। গত শুক্রবার (৩ মার্চ) রোহিঙ্গাভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল ‘রোহিঙ্গা রিয়েল ভয়েস’-এ প্রচারিত একটি ভিডিওতে আরসা নেতাকে উদ্ধৃত করে এক রোহিঙ্গার অডিও প্রচার করা হয়। অডিওতে অজ্ঞাত ওই রোহিঙ্গা নিজেকে আরসার সদস্য দাবি করেন এবং ক্যাম্পে যারা আরসাকে ‘দমনে’ জড়িত তাদের হুঁশিয়ারি দেন।

হুমকি দিয়ে আরও বলা হয়, ক্যাম্পে বড় ধরনের ঘটনা ঘটানো হবে, যদি আরসার ওপর ক্ষোভ বন্ধ না হয়। বার্তাটি প্রচারের দুই দিনের মাথায় দিনেদুপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো।


রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডেপুড়ে ছাই হয়েছে বহু আশ্রয়স্থল।

রোহিঙ্গা সূত্রের দাবি, রোববার (৫ মার্চ) বিকাল ৩টার দিকে আরসা সন্ত্রাসী হিসেবে ক্যাম্পে পরিচিত জনৈক এহসান ও ছমিউদ্দিনের নেতৃত্বে বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১১ এর ডি-এ ১৪ ও বি ব্লকে ১০/১৫ জনের একটি সশস্ত্র দুর্বৃত্তদল একটি ঘরে প্রথমে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর অল্প সময় আগে-পরে ডি-এ ব্লকসহ বি-ব্লকের একাধিক ঘরে আগুন জ্বলে ওঠে। দ্রুত আগুন চারদিক ছড়িয়ে পড়লে আরসার সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে প্রাণ রক্ষায় বসবাসরত রোহিঙ্গারা দিগবিদিক দৌঁড়ে পালায়। মুহূর্তে ক্যাম্পের বসতঘর, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, দোকান, দাতা সংস্থার হাসপাতাল, সার্ভিস ও লার্নিং সেন্টার পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

সোমবার (৬ মার্চ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার পাওয়া একটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, ক্যাম্পে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। বসতিতে নিজ হাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে একজন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ‘একজন রোহিঙ্গা একটি ঘরের চালে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে দেখে আমি ভিডিও করেছি। বেশ কয়েকটি স্থানে আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়।’ এটা পুরোটাই নাশকতা বলে মন্তব্য তার।

ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের অনেকেই জানান, রহস্যজনক আগুন নিয়ন্ত্রণে টানা তিন ঘণ্টা লেগে যায়। এ সময়ে দুই-আড়াই হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। গত সোমবার (৬ মার্চ) দুপুরের পর থেকে তদন্ত কমিটি ঘটনা অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে। আগামি ৩ কর্মদিবসের মধ্যে আগুনের কারণ বের করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।


অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা।

আগুন লাগার মূল কারণ এখনো অজানা থাকলেও ঘটনাটি রহস্যজনক মন্তব্য করেন কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আগুন লাগিয়ে দেওয়ার একটি ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এটা চোখে পড়েছে, তবে লোকটার চেহারা স্পষ্ট নয়। এরপরও এমন সব ভিডিওর সূত্র ধরে তদন্তের কাজ চলছে।

এদিকে, মঙ্গলবার (৭ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ক্যাম্প-১১ এর সিআইসি অফিসে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বৈঠক হয়। যেখানে সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো. ফখরুল আহসান, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ডিআইজি (এফডিএমএন) জামিল হোসেন ও অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছু দ্দৌজাসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন।

বৈঠক শেষে জামিল হোসেন জানান, গত রোববার আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় সন্দেহজনক এক কিশোরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে। ১৩-১৪ বছরের কিশোরটিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত কমিটির মুখোমুখি করা হবে।

তিনি আরও জানান, সামনের দিনে অনাকাঙ্ক্ষিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে আগুন নেভানোর নানা অসুবিধা ও পানির সঙ্কটের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবহিত করা হবে।

অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু দ্দৌজা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ঘর তৈরিতে সহযোগিতা শুরু করেছে। বাঁশ-তাঁবু দিয়ে বসতি করা হচ্ছে। জাতিসংঘের সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জরুরি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।


অগ্নিকাণ্ডের পরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চিত্র।

তিনি আরও জানান, অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি এখনো নিরূপণ হয়নি। আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ বা হতাহতের কোনো ঘটনা নেই। ঘটনাস্থলে পাঁচটি মেডিক্যাল টিম রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে, যেখানে ৯০ জন কমিউনিটি হেলথকর্মী কাজ করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাম্পজুড়ে শুধু পোড়া গন্ধ ও আগুনের ক্ষত।

আইওএমের ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার তারেক মাহমুদ জানান, সোমবার সকাল থেকে আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী তাঁবু দিয়ে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ইয়াকুব আলী জানান, আগুন লাগার পর প্রাণ বাঁচাতে এক কাপড়ে বাইরে এসেছিলাম। সব পুড়ে গেছে। এখন ২০টি বাঁশ ও একটি বড় তাঁবু দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে ঘর বানাচ্ছি।

নুর আয়েশা জানান, খাবারের জন্য বিস্কুট ও রান্না করা ভাত দেওয়া হয়েছে। বাঁশের ঘরও তুলে দেওয়া হচ্ছে।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে মনে হচ্ছে, এ আগুন পরিকল্পিত নাশকতা। ১২ লাখ রোহিঙ্গার ১০/১৫ হাজার অপরাধের সাথে জড়িত হবে। তাদের শনাক্তে যৌথ প্রচেষ্টা চালানো দরকার। এদের নিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হলেই ক্যাম্পে শান্তি বিরাজ করবে।

তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান জানান, সোমবার (৬ মার্চ) দুপুর থেকে আনুষ্ঠানিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও রহস্য অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে তদন্ত টিম। আমরা অগ্নিকাণ্ডের উৎসস্থল খোঁজার চেষ্টা করছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম- নানাভাবে যেখানে যে তথ্য প্রচার পেয়েছে সবকিছুর লিংক সংগ্রহের কাজ চলছে। সব তথ্যই আমাদের তদন্তের একটি অংশ হিসেবে ধরা হবে। ক্যাম্পে, ক্যাম্পের বাইরে, গণমাধ্যমকর্মীসহ সকলকে বলেছি যার কাছে যে তথ্য আছে বলে মনে হবে তা যেন আমাদের দিয়ে সহযোগিতা করে। আগামি ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের দ্রুত ঘর করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পুড়ে যাওয়া এলাকায় ৩৫টি মসজিদ-মক্তব, দুটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি হেল্প পোস্ট, একটি যুবকেন্দ্র, একটি নারীবান্ধব কেন্দ্র, একটি শিক্ষাকেন্দ্র, একটি শিশুবান্ধব কেন্দ্র ও একটি মানসিক পরিচর্যা কেন্দ্র নিচ্ছিন্ন হয়েছে। দিনের বেলা হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহত থেকে পরিত্রাণ মিলেছে।

উল্লেখ্য, এর আগে ২০২১ সালের ২২ মার্চ একই ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুন লেগেছিল। ওই সময় ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন পাঁচ শতাধিক। পুড়ে যায় প্রায় ১০ হাজারের বেশি ঘর। এবার আহতশূন্য আগুন বলে দেয়, আগুন লাগার আগেই রোহিঙ্গাদের পালানোর প্রস্তুতি ছিল।





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/634980/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8

Sponsors

spot_img

Latest

How Putin persuades Russians to cheer the war – POLITICO

Press play to listen to this article Voiced by artificial intelligence. MOSCOW — Among the perks offered to those stamping their feet to stay warm...

Watch Donovan Mitchell go after Zach Collins, both get ejected near end of Cavaliers win

It was about to be the Cavaliers' fifth-straight win — they have been as hot as any team in the NBA the past...

how much tennis missed her!

Naomi Osaka is a Master in communication: how much tennis missed her! © Bradley Kanaris / Stringer Getty Images Sport At the Brisbane International,...