২০২৩ সালকে স্বাগতম। তবে এই বছরটির ভালো-মন্দ নির্ভর করছে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তাইওয়ান নিয়ে চীনের পরিকল্পনা বিশ্বের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। কারণ এখানে সব পক্ষই শক্তিশালী অবস্থায় আছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতিও বিশ্বে প্রভাব রাখে। এই প্রতিবেদনে চলতি বছর কেমন হবে তা বিশ্বের ১০ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি ইস্যুর ওপর নির্ভর করছে। তবে এই ধারণা যে সঠিক হবে, সেটা বলা যাবে না।
ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে সংশয় : ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩ সালেও থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ কারো দাবি মেনে নেবে না। রাশিয়া চাইবে তার দখলকৃত অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিক ইউক্রেন এবং পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধবিরতির দিকে যাবেন না। তিনি ফেব্রুয়ারির আগে ইউক্রেনের ভূখণ্ড যেভাবে ছিল সেভাবেই দেখার পক্ষপাতী। রাশিয়া এটা মেনে নিলেই আলোচনায় যাবে কিয়েভ। ফলে সবাই নিজের অবস্থানে ঠিক থাকায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ইউরোপে ব্ল্যাকআউট! : প্রচণ্ড শীত অব্যাহত থাকলে ইউরোপ ব্ল্যাকআউটের মুখে পড়তে পারে। এটা এপ্রিলের আগেই হতে পারে। আগামী শীতে পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে। কারণ রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ রয়েছে। আবার তেল আমদানি নিয়েও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমনকি ইউরোপ তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। যারা পশ্চিমা বিশ্বের এই সিদ্ধান্ত মানবে মস্কো ইতিমধ্যে সেসব দেশে তেল রপ্তানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়ার গ্যাস দিয়ে হয়তো সর্বোচ্চ জুন পর্যন্ত চালানো যেতে পারে। গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ইউরোপকে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র বেছে নিতে হচ্ছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে! : ২০২৩ সালে না হলেও ২০২৪ সালে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। ২০২২-২৬ সালের মধ্যে যে কোনো একটি বছরে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে যাবে বলে ধারণা।
ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী থাকবেন? : বরিস জনসন এবং লিজ ট্রাস কেউই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ঋষি সুনাক এসেছেন লিজ ট্রাসের পরে। তিনি নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে অনেকেরই ধারণা, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবেন সুনাক। তবে ডানপন্থি এবং পার্লামেন্টের ব্যাকবেঞ্চাররা কী ধরনের পদক্ষেপ নেন তার ওপর নির্ভর করছে তার ক্ষমতায় থাকা না থাকা।
চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কী ফের ৫ শতাংশের বেশি হবে? : ২০২২ সালটা চীনা অর্থনীতির জন্য খারাপ সময় গেছে। জিরো কোভিড নীতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আবার চীনে সবকিছু খুলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে ব্যবসারও প্রসার হবে। এতে চীনের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। মানুষের খরচের পরিমাণ বাড়বে। ফলে দেশটিতে আবারও ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করাই যেতে পারে।
তাইওয়ানে হামলা চালাবে চীন? : চীন তাইওয়ানে হামলা চালাবে নাকি অবরুদ্ধ করে রাখবে—তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। তবে ২০২৩ সালে সেটা হবে না বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। চীন যদি প্রথমে হামলা চালায় তাহলে দোষের ভাগিদার হতে হবে। এতে চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরং তাইওয়ানকে প্রচণ্ড চাপে রাখতে অবরুদ্ধ করতে পারে। চীন চাইবে তার বিপরীত দিক থেকে গুলি আসুক। তাতে বিশ্বে সুবিধা পাবে। তবে তাইওয়ানকে বাগে আনতে না পারলে চীন কিছু একটা তো করতেই পারে। আবার ২০২৪ সালে তাইওয়ানে নির্বাচন হবে। সেটিও চীনের খেলার অংশ হতে পারে।
জুনে কি এরদোয়ানের ক্ষমতার ইতি ঘটবে? : জনপ্রিয়তা কমা সত্ত্বেও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ক্ষমতায় টিকে থাকতে সব ধরনের উপায় অবলম্বন করতে পারেন। এতে হয়তো দেশটির অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এরদোয়ান তার বিরোধীদের হয়তো রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করতে পারেন অথবা তাদের জেলে পুরে দিতে পারেন।
ইরানে বিক্ষোভ থামবে? : ইরানে নীতি পুলিশের হাতে মাহ্শা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ চলছে। শতাধিক বিক্ষোভকারী এখন মৃত্যুদণ্ডের মুখে। এরপরও বিক্ষোভ হলে সরকার আরো কঠোর হবে। এতে হয়তো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা ইরানের অর্থনীতি আরো খারাপ হবে। বিক্ষোভ আপাতত দমানো গেলেও বন্ধ হবে না। কারণ ভিন্ন উপায়ে আবার বিক্ষোভ শুরু হবে।
টুইটার টিকে থাকবে? : সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরম টুইটার ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার দিয়ে কিনেছেন ইলন মাস্ক। এতে প্রথম দিকে একটা বিবাদ তথা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে টুইটার আগের অবস্থায়ই ফিরে আসবে। মাস্ক ঘনিষ্ঠ কেউ টুইটারের প্রধান নির্বাহী হবেন। ৮ ডলারে গ্রাহক ফি ঋণের সুদ দিতে সহায়তা করবে। তবে মাস্কের ‘মুক্ত বক্তৃতা’র বিষয়টি ইউরোপে নতুন ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাক্টের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
সামরিকায়নের প্রচেষ্টা বাড়ার আশঙ্কা : ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার ভাবনটা বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বে। রাশিয়ার হামলার ভয়ে ইউরোপের দেশগুলো সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার তাইওয়ানে চীন হামলা চালাতে পারে এই আশঙ্কায় সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে জাপানও। আগের নীতি বদলে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। চীন ও উত্তর কোরিয়ার ভয়ে সীমান্ত সুরক্ষা নীতি জোরদার করেছে দক্ষিণ কোরিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারক ১০ পয়েন্ট : ১. বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা : প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াই করবেন কি না, তা নিয়ে একটা আলোচনা আছে। তবে এখন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। যদিও বাইডেন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেননি। না নিলে ২০২৩ সালটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনিশ্চয়তার বছর হবে। ২. বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী : প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনে ফের লড়াইয়ের ঘোষণা দিলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে মিশিগানের গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার এবং পরিবহনমন্ত্রী পিটি বুতিগিয়েগের নাম বেশি শোনা যাচ্ছে। ১৯৮০ সালের দিকে জিমি কার্টার তার সিনেটর টেড কেনেডির কারণে সমস্যায় পড়েছিলেন এবং দল বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে রিপাবলিকানরা সেই সুবিধা পেয়েছিল। ৩. মুদ্রাস্ফীতি : যুক্তরাষ্ট্রে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। মানুষের পকেট কাটা যাচ্ছে। কারণ গ্যাস ও তেলের দাম বেড়ে গেছে। তবে আশা করা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। কারণ, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ৪. বাইডেনের নীতির সফলতা : প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত দুই বছর ধরে কেবল নীতি প্রণয়ন করেছেন। বাকি দুই বছর এগুলো বাস্তবায়নের পালা। তবে বাস্তবায়ন করাটা কঠিন। প্রয়োগ করার মাধ্যমে জনগণ কতটা উপকৃত হয় তা বোঝা যাবে। এর ওপরই নির্ভর করছে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সফলতা। ৫. প্রতিনিধি পরিষদ রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে : জর্জিয়ার মার্জোরি টেলর গ্রিন প্রতিনিধি পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত। ফলে তিনি কেবল কংগ্রেসম্যান নয়, স্টেটসম্যানের ভূমিকাও পালন করতে পারেন। ৬. গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা : যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ মধ্যবর্তী নির্বাচনেও নির্বাচনের ফলাফল না মানা এবং অস্বীকার করার রীতি শক্ত হয়েছে। ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় জানুয়ারি ৬ কমিটির রিপোর্ট আরো বিভেদ সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের করের নথি প্রকাশও নতুন বিপদ ডেকে এনেছে। নির্বাচনি ফলাফলকে অস্বীকৃতির দিকে নিয়ে গেলে তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সুফল বয়ে আনবে না। এছাড়া গর্ভপাত নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত এবং বাইডেন প্রশাসনের কী পদক্ষেপ আসতে পারে তা আলোচনায় আছে। এটা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং ২০২৩ সালটা কেমন হবে তা নির্ভর করছে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির ওপর। এখানে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
—ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, সিএনএন ও দ্য গার্ডিয়ান