১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের ৪৮ বছর পূর্ণ হলো। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়—এই তিন দেশপ্রেমিকের অবদান সবচেয়ে বেশি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়ায় যে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেছিলেন, তারই পথপরিক্রমায় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ সম্পন্ন করে বাংলাদেশের যোগাযোগ মাধ্যমকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। আর সজীব ওয়াজেদ জয় এই দেশকে ডিজিটাল সংস্কৃতিতে উত্তীর্ণ করার সব প্রক্রিয়া দেখিয়ে ও পরামর্শ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে উদ্বোধন করেছিলেন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটি। গ্রীষ্মের গরমে কিন্তু প্রকৃতির সুশীতল স্নিগ্ধ ছায়াময় বাগানে বসেই বঙ্গবন্ধু চা পান করেছিলেন। অদূরে শুয়ে থাকা একটি কুকুরকে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তুইও আমার মতো ভুখা?’ হাতের বিস্কুট ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘নে খা।’ সে সময় চারপাশে ছিল ছোট ছোট পাহাড়। জনমানবহীন পাহাড়গুলো ছিল সবুজের গালিচা। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেলা ১১টায় বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূকেন্দ্রের প্রথম গেটে একটি হাতি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানায় এবং তাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র আজ আবার গুরুত্ব পেয়ে দেশ-বিদেশে পরিচিতি পাচ্ছে। বেতবুনিয়া কেন্দ্র শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংযুক্ত। তবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর এই কেন্দ্রের কার্যকারিতা আরও বেড়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু নিজ দেশে স্বাধীনভাবে তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী চিন্তার মাধ্যমেই স্বাধীন দেশে এই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র চালু করেন। প্রায় ১২৮ একরের জায়গার ওপর স্থাপিত কেন্দ্রটি ঊর্ধকাশে স্থাপিত কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষার ব্যবস্থা সচল করেছিল। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে ১১টি দেশের সঙ্গে টেলিফোন ডাটা কমিউনিকেশন, ফ্যাক্স, টেলেক্স ইত্যাদি আদান-প্রদান শুরু করা হয়। প্রায় ৩৫ হাজার ৯০০ কিলোমিটার ঊর্ধ্বাকাশে অবস্থিত কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে শক্তিশালী অ্যান্টেনা দিয়ে বার্তা বা তথ্য আদান-প্রদানের কাজ সম্পাদিত হয়েছে ২০১৮ সালের আগপর্যন্ত। তবে দীর্ঘ সময়ে এর উন্নয়নের আর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ক্ষমতায় আসীন পরবর্তী স্বৈরাচারী সরকার এবং ১৯৯০-এর পরে দুই দফায় দেশ পরিচালনায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রকে কার্যত অচল করে দেয়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের নিজস্ব ভূ-উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু কৃত্রিম উপগ্রহ ঊর্ধ্বাকাশে স্থাপনের পর বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রকে দ্বিতীয় স্টেশন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র এখন গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ১ কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের সুবিধা অনেক। সাধারণত টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এতকাল বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়া করা হতো। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে এই ভাড়া বাংলাদেশ সংগ্রহ করছে। এই কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে ডিটিএইচ বা ডিরেক্ট টু হোম ডিশ সার্ভিস চালু করা সম্ভব হয়েছে। এই কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মোট ফ্রিকোয়েন্সি ক্ষমতা হলো ১ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ। এর ব্যান্ডউইডথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত দূরবর্তী অঞ্চলে ইন্টারনেটের সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে। এর ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সেবা, টেলিমেডিসিন ও দূরনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
আসলে ২০২০ থেকে ২০২১ সালে করোনা মহামারিতে লকডাউনের মধ্যে অনলাইন প্ল্যাটফরম বেশি গুরুত্ব পাওয়া শুরু করলে ইন্টারনেট নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। তখন ভূ-উপগ্রহের মর্ম আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের টেলিযোগাযোগের প্রথম এন্টেনাটি। কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে এটি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের কাজ পরিচালিত হচ্ছে। একসময় সমগ্র বাংলাদেশে বৈদেশিক কল গ্রহণ ও পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল রাঙ্গামাটির এই কেন্দ্র। সরকার তথা রাষ্ট্র, বিদেশি কূটনীতিক কিংবা ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সব যোগাযোগ হতো এর মাধ্যমে। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনে এই কেন্দ্রের অবদান ছিল অপরিসীম। আশির দশকের বিশ্বকাপ ফুটবলে ম্যারাডোনার খেলা আর মুষ্টিযুদ্ধে সারা দুনিয়ার সেরা মোহাম্মদ আলীর খেলা হলে এই কেন্দ্রের মাধ্যমেই সমগ্র বাংলাদেশে তা দেখানো হতো। এমনকি বাইরের সব অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো এর মাধ্যমে।
বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক সমাজের সাংস্কৃতিক মানকে ডিজিটাল যুগের স্তরে উন্নীত করা একটি কঠিন কাজ। তার জন্য সঠিক নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দরকার ছিল। শেখ হাসিনা সেই কাজ সুনিপুণ পরিকল্পনায় বাস্তবায়ন করে চলেছেন। শিক্ষাসহ সরকারি-বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কল-কারখানা ও সেবাকে ডিজিটাল করা হচ্ছে। এতে দেশের মানুষের জীবনধারা ডিজিটাল যুগে পদার্পণ করেছে। মূলত দেশে থ্রি-জি সেবার জায়গায় ফোর-জি আনা হয়েছে। অবশ্য তার আগেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়েব পোর্টাল করেছি আমরা। ১৪ বছর আগে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বলে কিছু ছিল না। তখন আইটি খাত থেকে রপ্তানি আয় ছিল ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এখন ৫০০ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশকে তথ্য ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করে বেকারত্ব দূর করাকে অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আইটি পার্ক, পাশাপাশি আইটি ইনস্টিটিউট, আইটি বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়