রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বৎসর পূর্ণ হইতে যাইতেছে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি। যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে রাশিয়া নূতন করিয়া ইউক্রেনে বড় হামলা চালাইবার প্রস্তুতি লইতেছে—এই মর্মে কয়েক দিন পূর্বে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করিয়াছে যুক্তরাজ্যের একটি গণমাধ্যম। অনেকেই মনে করেন, বিশ্বের বর্তমান যেই পরিস্থিতি তাহাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলা যাইতে পারে। যদিও তাহা অফিশিয়ালি এখনো বলা যায় না। তবে গত বৎসর জুন মাসে এক সাক্ষাৎকারে পোপ ফ্রান্সিস স্পষ্ট করিয়াই বলিয়াছেন, ‘কয়েক বৎসর পূর্বে মনে হইয়াছিল—আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড লড়াইয়ের মুখোমুখি হইতেছি; কিন্তু এখন মনে হইতেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলিতেছে।’ পোপ ফ্রান্সিসের মতে, যাহারা ইহার নেপথ্যে রহিয়াছে তাহাদের লক্ষ্য অস্ত্র ব্যবসা, বৈশ্বিক স্বার্থ, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা।
প্রকৃতপক্ষে এই পৃথিবী কখনই যুদ্ধবিহীন ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অফিশিয়াল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইবে কি না—তাহা বড় প্রশ্ন বটে; কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করিতেছেন—ইহা আসলে অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বিশ্বযুদ্ধ এমন যুদ্ধকে নির্দেশ করে, যাহাতে বিশ্বের অধিকাংশ জাতিই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে বা জড়াইয়া পড়ে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ক্ষয়ক্ষতির কথা বলিতে গেলে বর্তমান বিশ্বে ‘অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি’ই সবচাইতে মারাত্মক। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে বিশ্বের প্রায় সকল দেশই অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হইতেছে। সেই হিসাবে এখন যাহা চলিতেছে তাহা যেন ছায়া তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আমরা দেখিয়াছি, এই ধরনের যুদ্ধের ক্ষেত্রে একরোখা রাষ্ট্রনায়করা ক্ষমতার মদমত্তে কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেন না। ইতিহাসে আমরা দেখিয়াছি—ক্ষমতার শিখরে পৌঁছাইয়া ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই ঘোষণা করিয়াছিলেন—‘আমিই রাষ্ট্র!’ বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায় আমরা দেখিয়াছি—সুচতুর রাজজ্যোতিষী পদ্য শুনাইয়াছিলেন: ‘লগ্ন তো সম্রাটের হাতে/ পঞ্জিকা কী বলে কী এসে যায় তাতে!’ অর্থাৎ প্রবল ক্ষমতাধর রাজা যাহা বলিবেন, তাহাই শেষ কথা, তাহাই আইন। অনেকে আবার তাহার দেশের নাগরিকদের উসকাইয়া দেয় যুদ্ধের জন্য। যেমন হিটলার বলিয়াছিলেন, ‘আই অফার ইউ স্ট্রাগল, ডেঞ্জার অ্যান্ড ডেথ।’ বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ও লেখক বার্ট্রান্ড রাসেল ১৯৫৪ সালে রচনা করেন ‘নাইটমেয়ার্স অব এমিনেন্ট পারসন্স’ নামে একটি গ্রন্থ। এই বইতে পৃথিবী বিখ্যাত কিছু ব্যক্তির কল্পিত দুঃস্বপ্ন লিপিবদ্ধ করা হয়। বইয়ের একটি অধ্যায় ছিল—‘স্তালিনের দুঃস্বপ্ন’। এই লেখাটি রাসেল লিখিয়াছেন স্তালিনের মৃত্যুর এক বৎসর পর। কল্পিত গল্পের পটভূমি হইল এই রকম—তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হইয়াছে। স্তালিন এইবার হারাইয়া গিয়াছেন। লাল মরিচ মিশানো এক গ্লাস সোমরস গলায় ঢালিয়া স্তালিন তাহার চেয়ারে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া তিনি দুঃস্বপ্নটি দেখিতেছেন। তিনি দেখিলেন—ছোট্ট একটি গ্রামের আটপৌরে একটি ঘরে বন্দি তিনি। ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ। আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে স্তালিনের মনের পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা হইতেছে। তিনি রাগে ফাটিয়া পড়িয়া বলিতেছিলেন—‘ভদ্র মহোদয়গণ, জীবনের আনন্দের আপনারা কতটুকু জানেন? একটা গোটা জাতিকে ভীতসন্ত্রস্ত করিয়া রাখিবার মধ্যে কী মাদকতাময় সুখের অনুভূতি আছে, তাহা বুঝিবার ক্ষমতা কি রহিয়াছে আপনাদের? যখন বুঝিতে পারিলেন—সকলেই আপনাকে ঘৃণা করিতেছে, কিন্তু প্রকাশ্যে সেই কথা বলিবার লেশমাত্র সাহস পাইতেছে না কেহ, তাহা এক নিবিড় আনন্দ। শুধু শত্রু নহে, ক্ষমতা রক্ষার জন্য বন্ধুকেও বিনাশ করা প্রয়োজন।’
যুদ্ধে কোনো না কোনো পক্ষ তো লাভবান হয়ই; কিন্তু ক্ষতি হয় মানব সভ্যতার, মানবতার। এই পৃথিবী তো মানবের তরে, দানবের তরে নহে। সেই জন্য আশাবাদীরা বলেন, শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হইবেই; কিন্তু মানুষের জয় হইবেই—এই বিশ্বাসে যেন ভাঙন ধরাইতে চাহে যুদ্ধবাজরা। যুদ্ধই তো তাহাদের ব্যবসা। ক্ষমতাধররা কি তাহাদের ব্যবসার ক্ষতি করিতে চাহিবে?