১১ বছর পর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা রংপুর সফরে এলেন। গতকাল তিনি রংপুর জেলা স্কুল মাঠে বিভাগীয় সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। রংপুরে তার এই আগমন শুধু রাজনৈতিক যোগাযোগই নয়, এ অঞ্চলের ভাগ্যোন্নয়নের সঙ্গেও সম্পর্কিত। রংপুরবাসীর প্রাপ্তি থেকে অনেক প্রত্যাশারও জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশির ভাগ সময় ক্ষমতায় থেকেছে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে যারা শাসনক্ষমতায় থেকেছেন তারা সবাই এ অঞ্চলের মানুষ। জিয়াউর রহমান বগুড়ার, এইচ এম এরশাদ রংপুর শহরের সন্তান এবং খালেদা জিয়া দিনাজপুরের সন্তান ও বগুড়ার বউ। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এ অঞ্চলের মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও নিজের এলাকা রংপুর অঞ্চলের জন্য উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন পাটাতন নির্মাণ করেননি বা করতে পারেননি। অথচ শাসকগণ দেশে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন—এটা সবার কাম্য।
রংপুর অঞ্চল উন্নয়ন-বৈষম্যের শিকার এবং এ বৈষম্য তথ্য বা কাগজে কলমে নয়, বাস্তবে দৃশ্যমান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ি রংপুর শহর থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে। তিনি এলাকাভিত্তিক উন্নয়নে বিশ্বাসী নন। দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়নই তার লক্ষ্য। দেশের অনন্য বেশ কিছু মেগা প্রকল্প তার নেতৃত্বেই সম্পন্ন হয়েছে এবং এখনো কিছু বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এ কারণে তার প্রতি জনগণের আস্থা যেমন বেশি, জনগণের জন্য তার দায়বদ্ধতাও বেশি। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই তিনি ২৫ জানুয়ারি ২০১০ রংপুরকে বিভাগ করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখানকার মঙ্গা দূর করেছেন। সরাসরি ঢাকা-রংপুর চলাচলকারী একমাত্র ট্রেন ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ চালু করেছেন। গ্যাসলাইন দিচ্ছেন (কাজ প্রায় শেষ), সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করছেন (কাজ চলমান)। রংপুর শহরে তৈরি করছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে আধুনিক বাস টার্মিনাল (কাজ শেষ)। চার লেনের এশিয়ান হাইওয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ঢাকা-বগুড়া হয়ে রংপুর দিয়ে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত (কাজ চলমান)। ২০১৪ সালে তিনি উদ্বোধন করেন ১ দশমিক ৫ কিমি দীর্ঘ তিস্তা সেতু (প্রায় দৃশ্যমান), যা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের চিলমারী এই দুই উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। পথ কমবে ১০০ কিলোমিটার। ২০১৮ সালে তিস্তার ওপর মহিপুর ব্রিজ উদ্বোধন করেন তিনি। গত বছর তিনি রংপুর বিভাগীয় সদর দপ্তরের আধুনিক দশতলা ভবন উদ্বোধন করেন ভিডিও কনফারেন্সে। এরকম অনেক ছোটবড় উন্নয়ন করেছেন ও করছেন।
এবার রংপুরে এসে প্রধানমন্ত্রী ৩০টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করছেন। বস্তুত এক রংপুর নগরীকে অন্যান্য নগরীর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, রংপুর বিভাগীয় শহর এখনো জেলা শহরের মতোই রয়ে গেছে। এখানকার নেতৃবৃন্দ শহরের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারেননি। এই শহরের কোনো মিশন-ভিশন নেই বললেই চলে। রাস্তাঘাট, ড্রেনেজব্যবস্থা, মশক নিধন, মৃতপ্রায় শ্যামসুন্দরী খালকে পরিচর্যা করে জীবনদান, বিভাগীয় বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ পুরো রংপুর শহরকে ঢেলে সাজাতে হবে। এজন্য মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে শুধু বাসযোগ্যই নয়, পরিবেশবান্ধব পর্যটন নগরীতে পরিণত করতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এমনটিই চান রংপুরবাসী।
১৯৪৪ সালে রংপুর রেল স্টেশনের সংস্কার করা হয়। এরপর বড় কোনো সংস্কার করা হয়নি ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ অবকাঠামোর। রংপুর রেল স্টেশন সংস্কারসহ ঢাকার সঙ্গে রেল যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি ও আধুুনিকীকরণ প্রয়োজন। ঢাকা-রংপুর-ভারত রেল-লিংক অসম্ভব কিছু নয় এখন। তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। এ মেগা প্রকল্প যাতে প্রকৃতির জন্য হুমকি না হয় এবং পরিবেশবান্ধব হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সৈয়দপুর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক হচ্ছে; কিন্তু বিভাগীয় শহর রংপুরে স্থানীয় বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ প্রয়োজন। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে এ অঞ্চলে এখনো আয়োডিনের ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এ অঞ্চলের মাটি বা পানি বা খাদ্যে আয়োডিনের মাত্রা পরিমাপসহ জনগণের খাদ্যাচরণ নিয়ে বৃহত্ পরিসরের গবেষণা করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। নতুবা এ অঞ্চলের জনগণ শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মক্ষমতা হারাবে বলে আমরা মনে করি।
এদিকে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এটাকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিয়ে অথবা এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ হাসিনা হল ও ড. ওয়াজেদ ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন। এমনকি, আগের উপাচার্যগণ শুধু এমফিল-পিএইচডি ফেলো ভর্তি করেছেন; কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতিসহ সার্বিক সরকারি অনুমোদন নেননি। ফলে ২০১১-১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২০৫ জন ফেলোর ডিগ্রি প্রদানে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বর্তমান উপাচার্য এসে যে ফাইল পাঠিয়েছেন তাতে দ্রুত অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন।
এ অঞ্চল কৃষি অঞ্চল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে গবেষণার মাধ্যমে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখবে। আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ইপিজেড স্থাপন, দিনাজপুর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রংপুরে স্থানান্তর, এবং পর্যটন এলাকার উন্নয়নসহ আরো মেগা প্রকল্প নেওয়া দরকার রংপুর অঞ্চলে। এ এলাকায় চাশিল্প আরেকটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এছাড়া গতকাল স্থানীয় নেতৃবর্গ রংপুরে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু নির্মাণ, রংপুর-বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ, শহরে ফ্লাইওভার ও এর পাশ দিয়ে বাইপাস সড়ক নির্মাণসহ নানা দাবি জানিয়েছেন। এসব দাবিও এখন বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং সহতথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ