রাশিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন পুতিন!


গত কয়েক দিন ধরে বিশ্বের চোখ রাশিয়ার ওপর। রাশিয়ার উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি দৃষ্টি আটকে রেখেছে আন্তর্জাতিক মহলের। রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা ও সেনা সরবরাহকারী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের সঙ্গে দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরোধ তুঙ্গে উঠলে ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্বসহ সারা বিশ্ব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে রাশিয়ার পরিস্থিতি। প্রিগোজিনের অভিযোগ ছিল, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনে ওয়াগনার সেনাদের ক্যাম্পে বোমাবর্ষণ করেছে। বস্তুত, ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হয়ে যুদ্ধ করতে যাওয়ার কয়েক দিন পর থেকেই শীর্ষ কর্মকর্তা তথা রুশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে থাকেন প্রিগোজিন। চূড়ান্ত পর্যায়ে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর উদ্দেশে প্রিগোজিনকে বলতে শোনা যায়, সেনাসামন্ত নিয়ে ‘হিসাব-নিকাশ’ চোকাতে মস্কো ঘেরাও করবেন তিনি! বাস্তবে ঘটেও তাই। মস্কোর রাস্তায় দেখা যায় ওয়াগনার গ্রুপের সাঁজোয়া গাড়িবহর! মস্কোয় অবস্থিত ইউক্রেন যুদ্ধের প্রধান রসদ ভান্ডার রোস্তভ-অন-ডন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ওয়াগনার বাহিনী। এই অবস্থায় রুশ ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) সশস্ত্র বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করতে থাকে প্রিগোজিনকে। ঘটনা এখানেই থেমে থাকে না, প্রিগোজিনের কর্মকাণ্ডকে ‘বিশ্বাসঘাতকতার শামিল’ ও ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে অবিহিত করেন পুতিন। এরপর পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকলে বেলারুশের হস্তক্ষেপে কিছুটা হলেও অবস্থার ‘থমথমে ভাব’ কাটে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, প্রিগোজিনের উদ্দেশে পুতিন কড়া কথাবার্তা বলেছেন বটে, তবে তিনি সরাসরি তার নাম নেননি। পুতিন বলেছেন, ‘বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হবে ভয়াবহ। পেছন থেকে ছুরি মারা লোকের কোনো ক্ষমা নেই!’ পুতিন এমন কথাও বলেছেন, ‘এর জবাব দিতে বিপুল সম্পত্তি ঘোচাতেও পিছপা হবে না রাশিয়া। কারণ, এটা জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ!’ অর্থাত্, প্রিগোজিন তথা ওয়াগনার বাহিনীর সঙ্গে বেশ বড় একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন পুতিন—এ কথার সঙ্গে দ্বিমত থাকতে পারে না। এই যখন অবস্থা, তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ‘পুতিন কি তাহলে রাশিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন!’

আসল কথা হলো, রাশিয়ায় বাস্তবিক অর্থে কী ঘটছে? আমরা দেখেছি, প্রিগোজিন ইতিমধ্যে একটি বিবৃতি জারি করেছেন, যাতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, শোইগুর সঙ্গে বাদানুবাদ ও রেষারেষির ফলস্বরূপ এই গন্ডগোল। যদিও বিবৃতিতে পুতিনকে নিয়ে বলা হয়নি কিছুই। এরপর হঠাৎ করেই নিজের বক্তব্য ও বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেন ওয়াগনারের প্রধান। এ সময় প্রিগোজিনকে বলতে শোনা গেছে, রাশিয়ায় রক্তপাত এড়ানোর চিন্তা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এ ঘটনার পর পুতিন সরকার প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়ে তাকে শান্তিপূর্ণভাবে বেলারুশে যাওয়ার অনুমতি দেয়। অর্থাত্, এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, রাশিয়ার সঙ্গে প্রিগোজিনের ঝামেলা আপাতত থামলেও ‘টানাপোড়েন’ থামছে না শিগিগরই!

অবস্থা পর্যবেক্ষণে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ‘রাশিয়ায় যা হচ্ছে, অর্থাত্, ওয়াগনার বাহিনীর সঙ্গে পুতিন বাহিনীর দ্বন্দ্বকে কি ছোট করে দেখার সুযোগ আছে? যুদ্ধরত পুতিন বাহিনীর সঙ্গে ভাড়াটে সেনাপ্রধানের এভাবে বিবাদে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা কি এতটাই তুচ্ছ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের তাকাতে হবে পেছনের দিকে। যে সংকটের আগুনে বিগত কয়েক দিন ধরে পুড়ছে মস্কো, তার শুরুটা ‘অকস্মাৎ দুর্ঘটনা’ নয় মোটেও! এমনটা ঘটতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছিল বেশ আগে থেকেই। রুশ কিংবা ওয়াগনার বাহিনীর আক্রমণের বিপরীতে যখন ইউক্রেনের যোদ্ধারা সফল পালটা আক্রমণ করছিল একের পর এক, তার সমুদয় দায় এসে পড়ছিল প্রিগোজিনের ওপর। ওয়াগনার বাহিনীকে ব্যবহার করেও যুদ্ধের ময়দানে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না পুতিন বাহিনী। ফলে স্বভাবতই এর দায় গিয়ে পড়ছিল ওয়াগনারের প্রধান হিসেবে প্রিগোজিনের কাঁধে। অন্যদিকে, প্রিগোজিন যুক্তি দেখিয়ে আসছিলেন এই বলে যে, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সেনা নেই, নেই যুদ্ধের রসদ। এভাবে যুদ্ধ করা কঠিন।’ বিশ্ব দেখেছে, বেকায়দায় পড়ে যুদ্ধের মাঠ থেকে সেনারা পালিয়ে পর্যন্ত যাচ্ছিল! এমন এক কঠিন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ওয়াগনারের প্রধানের ক্ষোভ বাড়তে থাকে শোইগু ও জেনারেল স্টাফ প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের ওপর। শুরু হয় উভয় পক্ষ থেকে প্রকাশ্য সমালোচনা ও কথা চালাচালি, যার চূড়ান্ত ফলাফল নিজের সেনাবহর সমেত ওয়াগনারের প্রধানের মস্কো অবরুদ্ধের চেষ্টা!

চলতি মাসের গোড়ার দিকে রাশিয়ার হাবভাব দেখে এমনটা মনে করা হচ্ছিল যে, প্রিগোজিনের লাগাম টেনে ধরার কথা ভাবছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এরপর সমস্ত বেসরকারি প্রতিরক্ষা কোম্পানির সেনাদের যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, ‘ঝামেলা একটা বাধবেই!’

মনে রাখতে হবে, ইউক্রেন যুদ্ধে প্রিগোজিনের বাহিনী বেশ ভালো করছে। যুদ্ধের মাঠে ওয়াগনার বাহিনীর পারফরম্যান্স তুলনামূলক ভালো—রাশিয়ার নিজস্ব বাহিনীর কথা বলা হোক কিংবা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর কথাই ধরা হোক। সত্যি বলতে, যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের বাহিনীর ওপর রাশিয়া তখনই চড়াও হতে পেরেছে, যখন থেকে ওয়াগনার বাহিনীর সেনারা রাশিয়ান বাহিনীর সেনাবহরে যুক্ত হয়েছে। এদিক থেকে হিসাব করলে রাশিয়ায় প্রিগোজিনের অবস্থান বেশ শক্তপোক্ত; অন্তত শোইগু বা অন্য যে কোনো সেনা কমান্ডারের থেকে এগিয়ে আছেন ওয়াগনারের প্রধান। রাশিয়ার নিয়মিত সেনাবাহিনীর চেয়ে প্রিগোজিন তার সেনাদের বেশি যত্নে রাখেন—এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং, প্রিগোজিনের সঙ্গে রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরোধ শিগিগরই মিটবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই! তাহলে পরিষ্কার হিসাব হলো, পুতিন-প্রিগোজিনের উত্তপ্ত সম্পর্কের পারদ এত সহজেই গলছে না!

বেশির ভাগ বিশ্লেষক মনে করেন, রাশিয়ার ওপর পুতিনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল। বহু বছর ধরে ‘শক্ত আসন’ গেড়ে বসেছেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্ষুব্ধ ওয়াগনার বাহিনীকে যেভাবে মস্কোর দিকে তেড়ে যেতে দেখা গেল, তাতে করে পুতিনের অবস্থানের বিষয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। প্রিগোজিনের এতটা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পড়াটা বাস্তবিক অর্থেই ‘ভিন্ন কিছু’র আলামত!

বিশেষভাবে উল্লেখ করার বিষয়, গত ৯ মাসে প্রিগোজিনকে শুধু শোইগু ও গেরাসিমভের ঘন ঘন সমালোচনা করতে দেখা যায়নি, বরং ‘ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার ভুল সিদ্ধান্ত’—এমন কথাবার্তাও বেশ কয়েক দফা উচ্চারণ করেছেন তিনি। এমনকি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের সামগ্রিক সমস্যা সম্পর্কেও কথা বলেছেন প্রিগোজিন। এই অবস্থায় এটা ধরে নেওয়া অবান্তর নয় যে, পুতিন-ওয়াগনার গ্রুপের আজকের উত্তপ্ত সম্পর্কের শিকড় বেশ গভীরে! মজার ব্যাপার হলো, সম্ভবত পুতিন নিজেও জানেন এ কথা! এই কথা বলার কারণ, বহু আগে থেকেই রুশ কর্মকর্তা বলে আসছিলেন, ‘প্রিগোজিনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অত সহজ নয়!’

‘ওয়াগনার গ্রুপ ইস্যু’ নিয়ে পুতিন যে গাড্ডায় পড়েছেন, তার আরেকটি প্রমাণ হলো, শীর্ষ রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রিগোজিনের সম্পর্কে অচলাবস্থা শুরু হলে পুতিনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন ওয়াগনারের প্রধান! রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে দেখে নেওয়া হবে বলে পালটা হুমকি দিয়ে আসছিলেন পুতিনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, প্রিগোজিনকে অক্ষত অবস্থায় চলে যেতে দেন পুতিন!

বলা হচ্ছে, এ ঘটনার রেশ কাটবে না রাতারাতি। বেলারুশে প্রিগোজিনকে বহুতল ভবনের জানালার সামনে দাঁড়ানোর সময় দুই বার ভাবতে হবে, পাছে জানালায় উড়ে এসে পড়ে বোমা-বুলেট! শুধু তা-ই নয়, খাবার মুখে পোরার আগেও প্রিগোজিনকে মাথায় রাখতে হবে, বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে পাঙ্গা নিয়েছেন তিনি! তবে হ্যাঁ, পুতিনও যে নাক ডেকে ঘুমাতে পারছেন বা পারবেন—এমন কথাও চিন্তার বাইরে রাখতে হবে। কারণ, পুতিন ক্রমশ গুলিয়ে ফেলছেন সবকিছু, যা একজন স্বৈরশাসকের জন্য যারপরনাই অসম্মানজনক ও দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ! এই অর্থে, এমন চিন্তা অযোক্তিক নয়—‘নিজস্ব কর্মকর্তা, সেনা সংস্থা তথা রাশিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন পুতিন!’

লেখক : আটলান্টিক কাউন্সিলের ইউরেশিয়া সেন্টারের জ্যেষ্ঠ পরিচালক ও ইউক্রেনে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত

আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন

 





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/649767/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%93%E0%A6%AA%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A8

Sponsors

spot_img

Latest

3 Negative Stories Entrepreneurs Tell Themselves (and How to Rewrite Them)

Opinions expressed by Entrepreneur contributors are their own. We tell stories to...

How to Watch the Northern Lights in the U.S. This Week

A solar storm this week means the Northern Lights are taking a trip south. The celestial display, also known as the Aurora Borealis,...

New 2024 Poll: Trump Far Ahead of DeSantis, But Poll Has Good News for Both

A new poll has Donald Trump, currently the lone Republican candidate for President in 2024, far outpacing his closest probable competitor, Florida Governor...

Europa League round of 16 draw: Date, UK start time, teams involved and how it works

The Europa League knockout round play-off ties will be decided this week as teams battle it out to join the group winners in...

Ethereum Stalls At $1,200, Why Bears Still Have The Upper Hand

Ethereum is still closely mirroring the price of bitcoin through the bear market and that has seen its price basically stall in the...