দৈনিক ইত্তেফাকের জন্ম আর দুটি পত্রিকার মতো সাধারণ নয়। ইত্তেফাক জন্ম নেয় জাতির ক্রান্তিকালে। যখন অবরুদ্ধ বাঙালি, বাঙালি জাতিসত্তা; বাংলার আকাশ-বাতাসে নিমজ্জিত ঘোর অন্ধকার, তখন এক চিলতে আলো হয়ে, এক মহান ব্রত নিয়ে লগ্ন ঘটে ইত্তেফাকের। তখন থেকেই ইত্তেফাক বাংলার গণমানুষের কথা শোনাচ্ছে বস্তুনিষ্ঠতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত দিয়ে।
ইত্তেফাক সৃষ্টির পিছনে ভূমিকা রেখেছে দুটি মুখ্য বিষয়। প্রথমটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার মুসলিম লীগের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে প্রয়োজন ছিল একটি সংবাদমাধ্যমের। দ্বিতীয়ত বাংলার শহর-প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রার প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে, জনমত গড়ে তুলতে একটি স্বাধীন গণমাধ্যম খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই দুই পাখির এক ঢিলে জন্ম হয় ইত্তেফাকের। ইত্তেফাক মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগের দলীয় পত্রিকা হিসেবে জন্ম নেয় তবে গান শোনায় গণমানুষের, বাংলার আপামর জনসাধারণের মুখপত্র হয়ে বজ্রকন্ঠ তোলে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং দৈনিক ইত্তেফাকের পথচলা একই সূত্রে গাঁথা; একই সুর, অভিন্ন আবেদন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে শাসন-শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন অসহ্য অসহনীয় হয়ে উঠলে ফুঁসে উঠে বাঙালি। তখন অস্ত্রের মুখে স্বাধিকারের ডাকে প্রকম্পিত করে তোলে আকাশ-বাতাস। আর সেই রণধ্বনির প্রকম্পনকে স্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্বলিত করেছিল দৈনিক ইত্তেফাক। পাকিস্তানি শাসনামলে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের সাথী ছিল ইত্তেফাক। জনমত সৃষ্টিতে এবং আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাতে বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল ইত্তেফাকের। দেশের বাইরে ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন-সংগ্রামে ইত্তেফাক জুগিয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন।
বস্তুতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তি আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের বিকাশে দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইত্তেফাকের ব্রত ছিল সত্য বলা। সত্য খবর পরিবেশন করা। মিথ্যা, বানোয়াট, রঞ্জিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত থেকে বিরত থাকা। ইত্তেফাক কখনই অসত্য বলেনি, নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে বিশ্লেষণ করেছে প্রকৃত ঘটনাকে। শুরু থেকেই ইত্তেফাক সাংবাদিকতার এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। তাই তার গ্রহণযোগ্যতা সর্ব মহলে, সর্ব দোয়ারে। যাত্রার সুদীর্ঘ ৭০ বছরে এসেও এই ব্রত থেকে সরে আসেনি ইত্তেফাক। এই দীর্ঘ সময়ে দেশে কতশত গণমাধ্যম এসেছে, গণমাধ্যমের কত রকমফের ঘটেছে, বিবর্তনের জোয়ারে পা মেলাতে না পেরে কত গণমাধ্যম বিলীন হয়েছে অথচ খানদানি পত্রিকা হিসেবে ইত্তেফাক আজও টিকে আছে। কারণ এটাই, ইত্তেফাক তার প্রতিশ্রুতি রেখেছে।
ইত্তেফাকের প্রতিশ্রুতি ছিল গণমানুষের আস্থা অর্জন করা এবং ধরে রাখা। মানুষের আস্থা অর্জন করা শক্ত ব্যাপার এবং আরও বেশি শক্ত হলো সেই আস্থাকে বজায় রাখা। এ বিচারে ইত্তেফাক শতভাগ সফল। জন্মলগ্নে ইত্তেফাক কথা দিয়েছিল বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা শোনাবে; কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবে না। কোনো অপশক্তি, পরাশক্তি বা অত্যাচারীর সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস করবে না। স্বাধীন ও অবাধ সাংবাদিকতার এই নীতি ইত্তেফাক আজও ধরে রেখেছে। তবে সুদীর্ঘ পথের এই যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না। আঘাত এসেছে বারবার। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয়েছে, নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করেছে, পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়েছে। কিন্তু দমে যায়নি ইত্তেফাক। বন্ধ হয়নি মানিক মিয়ার শানিত ছুরির কলাম। স্বাধীন ও অবাধ সাংবাদিকতা রুখতে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জারি করে সামরিক আইন। সরকার আপত্তিকর সংবাদ পরিবেশনের দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান করে। কিন্তু দৈনিক ইত্তেফাক তোয়াক্কা করেনি কোনো বাধানিষেধ। সামরিক আইনের বিধান অগ্রাহ্য করেই সেই সময়কার অসহযোগ আন্দোলনের খবর নিয়মিতভাবে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে। শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই ইত্তেফাককে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক ভবন পুড়িয়ে দেয়। তবুও দৈনিক ইত্তেফাক তাদের কাছে মাথা নোয়ায়নি।
নিজের অস্তিত্ব বিলীনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি নিরবচ্ছিন্নভাবে সব সময় সমর্থন জুগিয়ে গেছে বরাবরের মতোই। ১৯৬৬ সালের ১৭ জুন ইত্তেফাক পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রেফতার করা হয় সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকেও। সে সময়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপস করলে হয়তো মানিক মিয়া ইত্তেফাক প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নীতির কাছে অনড়। গ্রেফতার হওয়ার প্রায় ১০ মাস পর ১৯৬৭ সালের ২৯ মার্চ মানিক মিয়া মুক্তি পান। মুক্তি লাভের পর তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সাফ জানিয়ে দেন, ‘ইত্তেফাক যদি তার ঐতিহ্য অনুসরণ করে প্রকাশিত না হতে পারে, তাহলে তিনি সেই পত্রিকা প্রকাশে আগ্রহী নন।’ নীতি খুইয়ে কখনোই কারো সঙ্গে আপস করেননি তিনি। আজ মানিক মিয়া নেই। কিন্তু সেই নীতি বলবত আছে। ইত্তেফাক সেই নীতি বহাল রেখেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পটপরিবর্তনের সময়ে বরাবরের মতোই ইত্তেফাক তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর জারি রেখেছে। ন্যায়, সঠিক ও সত্য সংবাদ পরিবেশন করেছে। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। এখানেই ইত্তেফাকের স্বকীয়তা। প্রেক্ষাপট, যুগ ও সময়ের দাবি মেটাতে বিভিন্ন সময়ে ইত্তেফাকের গঠন ও বিন্যাসে নানা পরিবর্তন এসেছে; কিন্তু সত্য, ন্যায়, গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে ইত্তেফাকের অবস্থান প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো বদলায়নি। বদলাবেও না। তাই ইত্তেফাকের অবস্থান থাকবে সর্বদায় ১৮ কোটি বাঙালির হৃদয়ে। গৌরবের ৬৯ বছর পেরিয়ে ইত্তেফাক পা রেখেছে ৭০-এর কাতারে। এই শুভক্ষণে ইত্তেফাকের সব লেখক, পাঠক, সম্পাদক ও প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি