ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করার ২ শর্ত ও নিয়ম


মুসলমানদের অন্য অন্যতম এক ইবাদত কোরবানি। এ দিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করা নির্দেশ এসেছে কোরআনুল কারিমে। একজন স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলিম যদি ‘নিসাব’ পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকেন, তাদের পক্ষ থেকে একটি কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব বা আবশ্যক।

আর্থিক ও আত্মিক এ ইবাদত-বন্দেগি পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য রয়েছে বিশেষ শর্ত ও নিয়ম। আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমের একাধিক স্থানে শুধু তার জন্য কোরবানি বা ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ করেছেন এভাবে-

১. فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
অর্থ: ‘অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার : আয়াত ২)

২. قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ
অর্থ: ‘(হে রাসূল! আপনি) বলুন, অবশ্যই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১৬২)

কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত
তবে এ কোরবানির বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শর্ত। যার কোনো একটি না থাকলে কোরবানি হবে না। কেননা কোরবানি কোনো লোক দেখানো ইবাদাতের নাম নয়। বরং এটি শুধু আল্লাহর জন্য। কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা থেকে প্রমাণিত যে, কোনো নেক আমলই আল্লাহ তায়ালার কাছে ততক্ষণ পর্যন্ত গৃহীত হয় না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তাতে দুটি শর্ত পূরণ হয়। ঠিক এ ক্ষেত্রে কোরবানিও দুই হুকুমের ব্যতিক্রম নয়। শর্ত দুইটি হলো-

প্রথমত: কোরবানির জন্য প্রয়োজন ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা
কোরবানি হবে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। নিয়তে পরিশুদ্ধতা না থাকলে কোরবানি কবুল হবে না। দুনিয়ায় প্রথম কোরবানি হাবিল ও কাবিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে কাবিলের কোরবানি কবুল হয়নি। কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়া প্রসঙ্গে হাবিল বলেছিলেন-

‘আল্লাহ তায়ালা মুত্তাক্বিদের (পরহেযগার ও সংযমি) কোরবানিই কবুল করে থাকেন। (সুরা মায়িদা : আয়াত ২৭)

কোরবানিতে একনিষ্ঠতার প্রয়োজনীয়তা কতবেশি তা কোরআনের বর্ণনা থেকেই সুস্পষ্ট। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

‘আল্লাহর কাছে কখনো ওগুলোর (কোরবানির জন্তুর) গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (সংযমশীলতা); এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এই জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মশীলদেরকে। (সুরা হজ : আয়াত ৩৭)

দ্বিতীয়ত: কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী হওয়া
আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসূলের নির্দেশিত বিধান অনুযায়ীই কোরবানি করতে হবে। এ কোরবানিসহ কোনো ইবাদাতেই তার অংশীদার স্থাপন করা যাবে না। তবেই তার কোরবানিসহ যাবতীয় ইবাদাত কবুল হওয়ার আশা করা যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদাতে কাউকে শরিক না করে। (সুরা কাহফ : আয়াত ১১০)

এমনটি যেন না হয়…
যারা শুধুমাত্র বেশি করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কোরবানি দেয় অথবা লোক সমাজে সুনাম অর্জনের উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা দেখে উচ্চ মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে; তাদের কোরবানি যে ইবাদত নয়, তা সবারই জানা।

১০ জ্বিলহজ ফজর থেকে ১২ জ্বিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষ ও নারীর কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৭ ভরি সোনা অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রূপা বা এর সমপরিমাণ সম্পদ থাকবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।

টাকা-পয়সা, সোনা-রূপার অলঙ্কার, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, সৌখিন বা অপ্রয়োজনী আসবাবপত্র এসব কিছুর মূল্য কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

কোরবানির জন্য আরও যেসব শর্তাবলী গুরুত্বপূর্ণ; তাহলো-
কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট পশু রয়েছে। তবে এ সব পশুর বয়স এবং এক পশুতে কয়জন অংশগ্রহণ করতে পারবে এ সম্পর্কে ইসলামের অনেক দিকনির্দেশনা রয়েছে। আর তাহলো-

> কোরবানির পশু
এমন পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হবে যা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হল- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এগুলোকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহীমাতুল আনআম।’ হাদিসে এসেছে- ‘তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কোরবানি করতে পার।’

রাসূলুল্লাহ (সা.) উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো জন্তু কোরবানি করেননি ও কোরবানি করতে বলেননি। তাই কোরবানি শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে।

ইমাম মালিক (রা.) এর মতে, কোরবানিরজন্য সর্বোত্তম জন্তু হল শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) এ ধরনের দুম্বা কোরবানি করেছেন বলে বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে।

উট, গরু ও মহিষ সাত ভাগে কোরবানি দেয়া যায়। হাদিসে এসেছে- ‘আমরা হুদাইবিয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কোরবানি দিয়েছি।’

গুণগত দিক থেকে উত্তম হল- কোরবানিরপশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।

> কোরবানিরপশুর বয়স
কোরবানিরপশু পরিপূর্ণ বয়সের হতে হবে। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানিরপশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। আর তাহলো-
– উট : পাঁচ বছরের হতে হবে।
– গরু-মহিষ : দুই বছরের হতে হবে।
– ছাগল-ভেড়া-দুম্বা : এক বছর বয়সের হতে হবে।

> পরিপূর্ণ মালিকানা থাকা
কোরবানি দাতা যে পশুটি কোরবানি করবেন, তার উপর কোরবানি দাতার পরিপূর্ণ মালিকানাসত্ত্ব থাকতে হবে। যদি এ পশু বন্ধকের পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু হয় তবে তা দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না।

কোরবানির নিয়মাবলী
> মুখের উচ্চারণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। এভাবে বলা যায় যে- ‘এ পশুটি আমার কোরবানিরজন্য নির্দিষ্ট করা হল।’ তবে ভবিষ্যতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এমন বলা যে- ‘আমি এ পশুটি কোরবানিরজন্য রেখে দেব।’
> কাজের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা যায়। যেমন- কোরবানিরনিয়তে পশু কেনা অথবা কোরবানিরনিয়তে জবেহ করা। যখন পশু কোরবানিরজন্য নির্দিষ্ট করা হয় তখন কিছু বিষয় কার্যকর হয়ে যায়। আর তাহলো-

১. এ পশু কোরবানি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। দান করা যাবে না। বিক্রি করা যাবে না। তবে কোরবানি ভালোভাবে আদায় করার জন্য তার চেয়ে উত্তম পশু দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে।
২. যদি পশুর মালিক মারা যায় তবে তার ওয়ারিশদের দায়িত্ব হল এ কোরবানি বাস্তবায়ন করা।
৩. এ পশুর থেকে কোনো ধরনের উপকার ভোগ করা যাবে না। যেমন- কোরবানিরপশুর দুধ বিক্রি করা যাবে না। কৃষিকাজে ব্যবহার করা যাবে না। সাওয়ারি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পশম বিক্রি করা যাবে না। যদি পশম আলাদা করে তাবে তা সদকা করে দিতে হবে বা নিজের কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু বিক্রি করা যাবে না।
৪. কোরবানি দাতার অবহেলা বা অযত্নের কারণে যদি কোরবানিরনির্ধারিত পশুটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে, চুরি হয়ে যায় কিংবা হারিয় যায় তবে কোরবানি দাতার কর্তব্য হবে অনুরূপ বা তার চেয়ে ভাল একটি পশু ক্রয় করা। আর যদি অবহেলা বা অযত্নের কারণে না হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে দোষযুক্ত হয় তবে এ দোষযুক্ত পশু কোরবানি করা যাবে।
৫. যদি পশুটি হারিয়ে যায় অথবা চুরি হয়ে যায় আর কোরবানি দাতার উপর আগে থেকেই কোরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে সে কোরবানিরদায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে।
৬. আর যদি আগে থেকে কোরবানি ওয়াজিব ছিল না কিন্তু সে কোরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করে থাকে তবে চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে অথবা হারিয়ে গেলে তাকে আবার পশু কিনে কোরবানি করতে হবে।

মুমিন মুসলমানের উচিত, উল্লেখিত শর্ত ও নিয়মগুলো মেনে কোরবানি করা প্রত্যেকের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সুতরাং মুসলিম উম্মাহর উচিত, সব সময় পরিশুদ্ধ মানসিকতার প্রতি খেয়াল রাখা। কোরবানিসহ সব ইবাদাত-বন্দেগি গ্রহণযোগ্য করতে উপরোক্ত দুটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা একান্ত আবশ্যক।

হে আল্লাহ! কোরবানি হোক শুধুমাত্র আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। যথাযথ শর্ত ও নিয়ম মেনে কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। সবার কোরবানি কবুল করুন। আমিন।





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/650109/%E0%A6%88%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%86%E0%A6%9C%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AA%E0%A6%B6%E0%A7%81-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A7%A8-%E0%A6%B6%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%93-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%AE

Sponsors

spot_img

Latest

Injured world No. 8 Karolina Muchova casts doubt on Australian Open participation

Injured world No. 8 Karolina Muchova casts doubt on Australian Open participation © Getty Images Sport - Quinn Rooney World No. 8 Karolina Muchova...

“I have good weapons and I can go far”

Jannik Sinner after beating Schwartzman: "I have good weapons and I can go far" (Provided by Tennis World USA) Jannik Sinner overcame Diego Schwartzman...

Jayson Tatum roasts Grant Williams for trying to copy his celebration in Celtics-Suns

Tatum roasts Grant Williams for trying to copy his signature move originally appeared on NBC Sports BostonGrant Williams didn't miss a shot Wednesday...

YouTube prankster Jarvo claims responsibility for sex noise debacle in BBC studio that left Gary Lineker blushing before Liverpool beat Wolves in FA Cup

YouTube prankster Jarvo claims it was him who sabotaged the BBC studio before Liverpool’s FA Cup clash against Wolves on Tuesday night. The BBC’s...