৫০০তম দিনের গণ্ডি পেরিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, তা যেন থামছেই না! গত মাসে এক ঘোষণায় ন্যাটো প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গকে যখন বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘যুদ্ধকবলিত ইউক্রেনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি তহবিল প্রদানের কথা ভাবছি আমরা’, তখন কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, অচিরেই বন্ধ হচ্ছে না চলমান সংঘাত! স্টলটেনবার্গের এমন কথাকে কি নেয়াত ‘সাধারণ বিষয়’ মনে করার সুযোগ আছে? এ ধরনের ঘোষণার সহজ অর্থ কি এটা নয় যে, ‘অন্য কিছুর ইঙ্গিত’ দিয়েছেন ন্যাটো প্রধান? যা হোক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ৫০২তম দিনে দাঁড়িয়ে দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, ‘মনে হচ্ছে, বছরের পর বছর পার হলেও এই সংঘাত থামবে না!’
এমন কথা চিন্তা করার পেছনে যুক্তি আছে বইকি। সারা বিশ্ব গভীর উদ্বেগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করে আসছে—রাশিয়া, ইউক্রেন ও আমেরিকা—কোনো পক্ষই যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পথে হাঁটছে না। এসব দেশের মানুষ স্বভাবতই যুদ্ধের দামামা থেকে পরিত্রাণ পেতে উন্মুখ হয়ে আছে, কিন্তু তাদের চাওয়া-না চাওয়ায় কীই-বা আসে যায়?
জেলেনস্কি খুব ভালো করেই জানেন, চলমান সংঘাত বন্ধে আলাপ-আলোচনা তথা সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। তিনি এ কথাও জানেন, যুদ্ধ সমাপ্তির প্রশ্নে তথা রুশ সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করাতে মস্কোকে রাজি করানোর কথা চিন্তা করাটাও ‘অলীক কল্পনা’। এই বিচারে তিনি যে কাজটি করতে পারেন তা হলো, বড় পরিসরে হামলা শুরু করা। ব্ল্যাক সি (কৃষ্ণসাগর) অঞ্চলে কয়েক হাজার রুশ সেনাকে ঘেরাও করে ফেলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইউক্রেনের শাসক কি সে পথে হাঁটার সুযোগ পাচ্ছেন? কিংবা জেলেনস্কি যদি এমন চিন্তা করে থাকেন যে, রাশিয়ায় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের হাত ধরে সংঘাতের যবনিকা পতন ঘটবে, বাস্তবসম্মত ভাবনা বলা যাবে না তাকেও। কারণ, তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা নেই শিগিগরই! এমনকি এটাও মাথায় রাখা দরকার, পুতিনের পর যিনি রাশিয়ার সিংহাসনে বসবেন, তিনিও যে শান্তির পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখবেন না, তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে? বরং ভবিষ্যতে পুতিনের থেকেও কঠোর শাসককে মস্কোর নেতৃত্বদানকারী হিসেবে দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা ও সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান প্রিগোজিনকে বিদ্রোহের মশাল হাতে তেড়ে আসতে দেখা গেছে খোদ মস্কোর দিকেই! সত্যি বলতে, এমন জেনারেলই চান রাশিয়ার জনগণ। তাদের চাওয়া, ঠিক এমন ক্ষীপ্রগতিতেই কিয়েভের দিকে ধেয়ে গিয়ে ইউক্রেনকে কবজা করতে হবে। ওয়াগনার প্রধান নিজের লোকজনের বিরুদ্ধেই প্রকাশ্য বিষোদ্গার করেছেন তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে, যা প্রশংসা কুড়িয়েছে রুশ জনতার।
যা হোক, যেমনটা বলা হয়েছে আগেই—ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সমুদ্রে তীব্র প্রতিরোধযুদ্ধের মাধ্যমে কয়েক হাজার রুশ সেনাকে বন্দি করে যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে পারে মস্কোকে। কিন্তু ইউক্রেনের সেনাদের দ্বারা এটা কি সম্ভব হবে কখনো? বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত শক্তি-সামর্থ্যের অভাবে ইউক্রেনীয় বাহিনী রীতিমতো পর্যুদস্ত! সেনা ভান্ডারে নেই কাঙ্ক্ষিত সক্ষমতার অস্ত্রশস্ত্র। জার্মান লেপার্ড ট্যাংক হাতে পাওয়ার পর মনে হয়েছিল, এবার যুদ্ধের মাঠ কাঁপাবে ইউক্রেনের সেনারা। যদিও বাস্তব চিত্র সে কথা বলছে না। আমরা দেখছি, জার্মান লেপার্ডের চেয়েও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে রাশিয়ার হাতে। অ্যান্টি ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র তো বটেই, দুর্দান্ত সব যুদ্ধসরঞ্জাম রয়েছে রুশ সেনাশিবিরে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইউক্রেনের সেনারা যে এম.১ ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে, তা-ও ধোপে টিকছে না রুশ সেনাদের আক্রমণের মুখে।
এ কথা সত্য, আক্রমণের ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে বড় ধরনের সাফল্য না পেলেও—যেমনটা ভবিতব্য ছিল—পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে পাওয়া ধ্বংসাত্মক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইউক্রেনীয় বাহিনীর শক্তিমত্তা বাড়াতে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে এর পরও প্রশ্ন থেকেই যায়, এতে করে কি ‘চূড়ান্ত মীমাংসা’ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হবে? স্পষ্ট করে বললে, রাশিয়াকে আলোচনার টেবিল অবধি নিয়ে যাওয়া কি এতুটুকুতেই সম্ভব?
এ প্রসঙ্গে লক্ষ করার বিষয়, জেলেনস্কি যেমন যুদ্ধবিরতির উদ্যোগকে পাশ কাটিয়ে চলেছেন, একই কাজ করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। হ্যাঁ, এটাই আসল সত্য। জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতির চুক্তির টেবিলে বসতে চান, তবে সেক্ষেত্রে তিনি ‘ক্রিমিয়া ইস্যু’ নিয়ে শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। পুতিনও যে সহজে কথা শোনার পাত্র—এমনটাও বলা যাবে না। মনে থাকার কথা, মাত্র এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ইউক্রেনকে করায়ত্ব করার চিন্তা করেছিলেন পুতিন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কী ঘটছে? ৫০০ দিন পার হলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই!
মজার ব্যাপার হলো, ইউক্রেনের মাটিতে বিজয় নিশ্চিত করতে চাইলে লাখ বিশেক রুশ সেনা এক জায়গায় জড়ো করার দরকার পড়বে—এমন বাস্তবসম্মত কথা পুতিনেরও অজানা নয়। কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সেই পথে হাঁটছেন না পুতিন!
আসলে যে ভয়ের কথা আন্দাজ করেছিলেন পুতিন, সম্ভবত তা-ই পেয়ে বসেছে তাকে! হয়তোবা শক্তিশালী কিছুর ভয় ঢুকে গেছে তার মধ্যে! এটা খুব তুচ্ছ বিষয় নয় যে, রাশিয়ার সেনাশিবিরগুলোতে বিপুলসংখ্যক অল্প বয়সি সেনা রয়েছে, যাদের অধিকাংশের বয়স বিশের নিচে। এসব সেনাকে যদি ‘অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বলি হতে হয়, তবে তা পুতিনের জন্য ‘কাল’ হয়ে উঠবে। তাদের পরিবার মস্কোর রাস্তায় নেমে আসবে হাজারে হাজারে। তীব্র প্রতিবাদ-আন্দোলনে ফেটে পড়বে রেড স্কয়ার। সেক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনী রাশিয়ার সন্তানহারা মায়েদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ুক, তেমনটা নিশ্চয় চাইবেন না পুতিন।
পুতিন শুরু থেকেই এই যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করতে চাইছেন না, বরং একে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে অবিহিত করছেন। তার দাবি, এটা ‘আদর্শিক লড়াই’। সত্যিই যদি তাই হয়, তবে প্রশ্ন থেকে যায়, পুতিন থেমে থেমে লড়ছেন কেন? বিশাল সেনাবহর নিয়ে গোটা ইউক্রেন রাতারাতি দখল করতে পারছেন না কেন?
শুরু থেকেই আরেকটি কৌশলের পথে হাঁটছেন পুতিন। সারা বিশ্বের সামনে তিনি এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে, রাশিয়া এমন এক দেশ, যা অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। পুতিন সবাইকে এ কথা বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়ার হাতে এমন কিছু আছে, যা অন্য কোনো দেশের হাতে এখনো পর্যন্ত নেই। পুতিনের ভাষ্য অনুযায়ী, রাশিয়া ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’, যা তার শক্তির মূল জায়গা। পুতিনের এমন ভাবনা একবারে অবান্তর নয়। শুধু খাদ্য ও জ্বালানিতেই স্বাবলম্বী নয়, বরং যুদ্ধের মুখে টিকে থাকতে প্রয়োজনীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং বেসামরিক জনসংখ্যাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবই আছে রাশিয়ান ফেডারেশনের হাতে। এমনকি পুতিন এ-ও বিশ্বাস করেন, প্রয়োজনের তাগিদে সব ধরনের বিলাসিতা বাদ দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার ওপর জোর দেবেন রাশিয়ার নাগরিকেরা।
পুতিনের আরেকটি বড় ভয় হচ্ছে ‘মূল্যস্ফীতি’। কেননা, মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় রাখতে না পারলে তার প্রভাব পড়বে যুদ্ধক্ষেত্রে, তথা রুশ সেনাদের ওপর। এবং এর অভিঘাতে সেনাদের কাছ থেকে বড় ধরনের হুমকি আসতে পারে—এমন আশঙ্কাও আছে। ওয়াগনার সেনাদের বিদ্রোহ শান্ত করতে গিয়ে গেল কয়েক দিনে পুতিন যে শিক্ষা পেয়েছেন, তা আর নতুন করে বলে দেওয়ার দরকার নেই।
সবশেষে বলতে হয়, কোনো পক্ষ হয়তো ভেতরে ভেতরে চায় না, সংঘাত বন্ধ হোক! তা না হলে লড়াই থামার কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না কেন? ইউক্রেন যুদ্ধ প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো সর্বাত্মক যুদ্ধ নয়—এরকম কথা বহু বার বলা হয়েছে। কিন্তু এই ‘সীমিত’ পরিসরের সংঘাতই এতটা লম্বা হচ্ছে কেন? যুদ্ধ বন্ধ করা না গেলে একটা পর্যায়ে কোনো একটি পক্ষের হাত ধরে যদি পারমাণবিক সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে, তবে তা পুরো পৃথিবীকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে—এমন বাস্তবতার কথা বারংবার বলা হলেও তাতে কেউ কর্ণপাত করছে না! এভাবে চলতে থাকলে ৫০০ দিন কেন, বছরের পর বছর অতিবাহিত হলেও থামবে না এই যুদ্ধ!
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
‘আনহার্ড’ থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন