চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন


সময়ের পরিক্রমায় ঘুরেফিরে আসে দুঃসহ স্মৃতিবিজড়িত সেই ২৯ ডিসেম্বর। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বরের এই দিনটিতে বাংলাদেশের চারণ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত এবং সাংবাদিকতার জগতে এক অনন্য নাম মোনাজাতউদ্দিনের অকাল মৃত্যু ঘটে। তার এই অকাল মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি। আজ থেকে প্রায় ২৫/২৬ বছর আগের সেই ঘটনাটি আজও আমার স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে ভাসে।  এ দিনে মোনাজাত ভাইকে নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করার ইচ্ছা জাগে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে একজন বস্তুনিষ্ঠ, নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকের কিছু কথা।  

মোনাজাত ভাইয়ের বাড়ি রংপুর শহরে। আমার বাড়িও রংপুরে। মোনাজাত ভাই এ দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সমস্যাজর্জরিত পিছিয়েপড়া দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলের মানুষের দুঃখদুর্দশার কথা লিখতেন। লিখতেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সমস্যা নিয়ে। একটা সময় ছিল যখন বৃহত্তর রংপুর জেলার অধিকাংশ স্থানে প্রতিবছর আশ্বিন ও কার্তিক মাসে মঙ্গার প্রাদুর্ভাব দেখা দিত। এই সময়টাতে তাদের হাতে কোনো কাজ থাকত না। ফলে অর্থাভাবে অনেকে কচুঘেঁচু খেয়ে জীবনধারণের চেষ্টা করত। উন্নয়নের দিক থেকে সামগ্রিকভাবে দেশের উত্তরাঞ্চল পিছিয়ে থাকলেও বৃহত্তর রংপুর জেলা আরো পশ্চাৎপদ থাকায় মোনাজাত ভাই মঙ্গাদুর্গত প্রত্যন্ত অঞ্চলের সচিত্র সংবাদ তার লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতেন। গণমাধ্যমগুলোর কল্যাণে সরকারসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব দুর্গত মানুষের সাহাযার্থে এগিয়ে আসত। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন যথার্থই বলেছেন, ‘যে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, সেদেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।’ এই বাস্তব সত্যকে বুকে ধারণ করে তিনি লিখে গেছেন। মোনাজাত ভাইয়ের মতো সাংবাদিকরা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের খবর লিখে গেছেন এবং লেখেন বলেই রংপুরসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চল থেকে আজ মঙ্গা বা অভাব দূরীভূত হয়েছে। এরকমই একটি সচিত্র প্রতিবেদনসহ সংবাদ প্রকাশের কাজে তিনি সেদিন তিস্তামুখঘাটে গিয়েছিলেন যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরের সংবাদ তৈরির কাজে।

আমি কয়েক দিনের ছুটিতে দেশে গিয়েছিলাম। যেদিন সপরিবারে ঢাকায় ফিরছিলাম, সেদিন মোনাজাত ভাইয়ের সঙ্গে একই ট্রেনের যাত্রী ছিলাম। এরকম একজন মেধাবী, জ্ঞানী, নিবেদিতপ্রাণ লেখক সর্বোপরি দেশপ্রেমিক মানুষের সাহচার্য পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছিলাম। তিস্তামুখঘাটে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত ট্রেনে গল্প করতে করতেই ফেরিঘাটে নেমেছি। ফেরিতে প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে মোনাজাত ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। ভিড় এড়াতে ফেরির একপাশে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। ফেরি চলছিল। নদীর মাঝ বরাবরে হঠাৎ ঝুপ করে ফেরির ছাদ থেকে ভারি কিছু একটা পানিতে পড়েই প্রচণ্ড স্রোতের মধ্যে ডুবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে হৈহুল্লোড়,চিৎকার, চেঁচামেচি। কি হলো জানার জন্য একে-ওকে জিগ্যেস করেও কোনো সদুত্তর পাচ্ছিলাম না। পরে জানতে পেলাম ফেরির ছাদ থেকে কেউ একজন পানিতে পড়ে ডুবে গেছে। দেখতে দেখতেই ফেরি বেশ দূরে চলে গেছে। দূর থেকে দেখছিলাম, নৌকা নিয়ে মাঝিরা ছোটাছুটি করছে। চেষ্টা করছে ডুবন্ত মানুষটিকে নৌকায় টেনে তুলতে। এরপর ফেরি যখন বাহাদুরাবাদ ঘাটে এসে পৌঁছালো, দেখলাম ফেরির পাটাতনে যাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রিয়মুখ অনেক ভালোলাগা, ভালোবাসার মানুষ চারণ সাংবাদিক মোনাজাত ভাই। বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিছুক্ষণ আগেই যার সঙ্গে কত গল্প, কত কথা বলেছিলাম, কত স্বপ্নের কথা শুনেছিলাম, তিনি এভাবে নিস্তেজ, নির্জীব হয়ে স্বজনহীন অবস্থায় ফেরির পাটাতনে লাশ হয়ে পড়ে থাকবেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তাকে আর তার লেখাকে অত্যন্ত পছন্দ করতাম বলেই, হয়তো তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পূর্বে এমন করেই আমার সঙ্গে তার শেষ দেখা হলো।

রংপুর শহরের কোতয়ালীপাড়ায় ১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি বুধবার প্রোথিতযশা এই সাংবাদিকের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি গল্প, কবিতা, গান আর নাটক লিখতেন। তার জীবনের লক্ষ্যই ছিল সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃত্ত করা। ষাটের দশকে বগুড়া থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বগুড়া বুলেটিন’-এর মাধ্যমে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। ১৯৬২ সালে তিনি যোগ দেন, দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তিনি ‘দৈনিক রংপুর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।

মেধা শ্রম, নিষ্ঠা আর বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জগতে এক অনন্যদৃষ্টান্ত স্থাপন করেন মোনাজাত উদ্দিন। সংবাদশিল্পে তিনি পথিকৃৎ হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত হন। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৬ সালে দৈনিক সংবাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এরপর তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকায় সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। মোনাজাত ভাই তার সাংবাদিকতা জীবনের ২০টি বছর দৈনিক সংবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ সময়ে তিনি সাংবাদিকতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেন। তার লেখার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি তার সৃজনশীল লেখনী দ্বারা খুব সহজেই পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পারতেন। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য তিনি ফিলিপস পুরস্কার, জহুর হোসেন স্বর্ণপদকসহ অনেক পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেন। এসব বইয়ের মধ্যে ১৯৯১ সালে ‘পথ থেকে পথে’, কান সোনার মুখ’, ১৯৯২ সালে পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, ছোট ছোট গল্প, ১৯৯৩ সালে শাহ আলম ও মুজিবের জীবনী, ১৯৯৫ সালে চিলমারীর একযুগ অন্যতম। মোনাজাত ভাই ঘুণেধরা এ সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত, স্বর্থপর, লোভী আর সুবিধাবাদী মানুষগুলোর বিচিত্র সব চরিত্র খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, যার সবটা না হলেও কিছুটা তার লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে।

মোনাজাত ভাই নেই। তার অভাব দারুণভাবে অনুভব করি। বিশেষ করে রংপুরবাসী। তিনি বেঁচে থাকলে তার লেখনীর মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে আরো অনেক অবদান রাখতে পারতেন।  মেধা, শ্রম আর নিষ্ঠার এক অনন্য প্রতীক এই চারণ সাংবাদিক। আমাদের এ কৃতী সন্তান স্মরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন তার কর্মের মাধ্যমে, লেখনীর মাধ্যমে।

লেখক : অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/626040/%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A8

Sponsors

spot_img

Latest

Coinbase (COIN) Cuts Another 20% of Workforce amid Persistent Crypto Winter

Coinbase (COIN) has made a fresh round of layoffs. The crypto exchange announced on Tuesday that it had fired about 950 people –...

Berhalter set to return as US coach

Gregg Berhalter is set to be re-appointed as the head coach of the US national team, six months after he left the role,...

Don’t mind Borthwick, dropping Farrell is a big deal

Steve Borthwick can play it down as much as he wants but dropping Owen Farrell to the bench is the biggest call...

Liverpool star Trent Alexander-Arnold reveals long-term position could be in midfield after dazzling England display

Trent Alexander-Arnold’s days as a standard right-back may be coming to an end after an impressive display in England’s midfield. Eyebrows were raised ahead...