১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতির নোংরা খেলায় নামে খুনি চক্রের দোসররা। শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ভূমিকাও যাতে কেউ জানতে না পারে, এই লক্ষ্যে নানা ধরনের কুত্সা ও অপবাদ ছড়ানো হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামে। ঘাতকদের মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ যেন আবার ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, তা বাস্তবায়ন করা। এর ফলে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বীরত্বগাথা এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল ছিলেন একজন কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সন্তান, যার সাহসিকতা, দেশপ্রেম এবং মানুষকে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বিষয়ে শিক্ষা হতে পারে তরুণ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস। ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
আট-দশ জন কিশোরের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা হয়নি শেখ জামালের। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ২ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং ১৪ মে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্য হলো, ৩০ মে পুনরায় গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির আলোয় আনতে গিয়ে নিজের পরিবার-পরিজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। আর পিতার স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তার সন্তানেরা।
সেই দুঃসহ দিনগুলোতে এ রকম অনেক দিন চলে গেছে, যখন শিশু শেখ জামালকে নিয়ে বঙ্গমাতা তার দুঃসময় অতিবাহিত করেছেন। তবে এর পরই সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। পিতার সংগ্রাম দেখতে দেখতে শেখ জামাল ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা শেখ জামালের গিটার শেখার প্রতি দুর্বলতা ছিল। একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে শখ পূরণ করেছিলেন কিশোর শেখ জামাল। একজন ভালো ক্রিকেটারও ছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকে অধিকাংশ সময় জেলে থাকতে হয়েছিল বলে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা এবং বড় বোন শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় ছোটবেলা থেকেই মানবিক চেতনায় গড়ে তুলেছিলেন শেখ জামালকে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজেদের বাড়িতে অবস্থানকালেই রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠেছিল তার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তার লেখা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ জামাল পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে গৃহবন্দি ছিলেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট ধানমন্ডির তারকাঁটার বেড়া দেওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে ভারতে যান। ধরা পড়লে মৃত্যু ছিল অনিবার্য। ভারতের আগরতলায় পৌঁছানো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে কিশোর শেখ জামাল পৌঁছালেন উত্তর প্রদেশের কালশীতে। মুজিব বাহিনীর (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে শেখ জামাল ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ৯ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন।
দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধের ফ্রন্ট থেকে যুদ্ধের পোশাকে দেশে ফেরেন শেখ জামাল। ভাইকে কাছে পেয়ে বড় বোন শেখ হাসিনা, ছোট বোন শেখ রেহানা আর ছোট ভাই শেখ রাসেলের মনে বয়েছিল আনন্দের জোয়ার, যেন পুরো পরিবারেই ছিল সেদিন খুশির আমেজ। ঐ দিনই বিকালে পল্টনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম আয়োজিত জনসভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ জামাল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে সামরিক পোশাকে পিতার সঙ্গে দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্র শেখ কামাল আর শেখ জামাল।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পূর্ণাঙ্গরূপে গঠিত হলে শেখ জামাল সেনাবাহিনীর লং কোর্সের প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার হন। ১৯৭৪ সালে শেখ জামাল যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নিজেকে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলার প্রবল আগ্রহ দেখে শেখ জামালকে বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেছিলেন যুগোস্লাভিয়ার সাবেক রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটো।
প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ঢাকা সেনানিবাসে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন শেখ জামাল।
কর্মক্ষেত্রে সব সময়ই দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন শেখ জামাল। আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় কখনো প্রকাশ পায়নি তিনি রাষ্ট্রনায়কের সন্তান। ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কয় বছরের জীবন ছিল শেখ জামালের? মাত্র ২২ বছরের জীবনে দেশপ্রেম আর কর্মদক্ষতার যে ছাপ রেখেছিলেন তিনি, তা আজ স্মরণ করতে হয়। শহিদ শেখ জামাল আজ শুয়ে আছেন বনানী কবরস্থানে, তার পাশেই আছেন স্ত্রী রোজী জামাল, যিনি ঐ রাতেই শহিদ হয়েছিলেন সবার সঙ্গে। তাদের বিয়ে হয়েছিল আগের মাসে ১৭ জুলাই। শেখ জামালকে আমরা স্মরণ করছি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সন্তান হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন শহিদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল।
লেখক: সাংবাদিক