নির্বাচন সামনে। রাজনৈতিক প্রতিনিধি কে হবেন, তার নির্বাচন এটি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। বিশেষ করে, ২০১৪ এবং ২০১৮-এর বিতর্কিত নির্বাচনের পর আগামী নির্বাচনটির গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে গেছে। বিষয়টি পৃথিবীর বেশ কিছু মুরুব্বি দেশ অনুধাবন করেছে ইতিমধ্যেই। তৎপরও তারা নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই রয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো আমেরিকার নাম। বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূতই শুধু নন, আমেরিকার জনপ্রতিনিধিরাও বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন নিয়ে বেশ তৎপর। নির্বাচনকে নিয়ে তারা বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন একটি ভিসা-নীতিও করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ভোট-সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলে সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়ে ছয় জন কংগ্রেসম্যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে চিঠি দিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাস ও হাইকমিশন বিবৃতি দিয়েছিল। তাদের এই বিবৃতি যে বাংলাদেশ সরকার ভালোভাবে নেয়নি, তা জানাতে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ১৩টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে বাংলাদেশ অসন্তোষ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ জানিয়ে দেয়, তাদের এমন কার্যকলাপ কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। রাষ্ট্রদূতদের কৈফিয়ত কিংবা উত্তর কী ছিল, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে এর আগে আমেরিকা বিষয়টি স্পষ্ট করে দাবি করে যে, বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কথা বলাকে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করে না। এরপর জাতিসংঘের নজরদারিতে সাধারণ নির্বাচন হোক বাংলাদেশে—হাসিনা প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়িয়ে এমনই দাবি জানিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসের ১৪ জন সদস্য। জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তারা এ নিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন।
উত্তরাধিকারী নির্বাচন নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ধনী এক পরিবার প্রধানের গল্প বলি। ‘ওয়াল স্ট্রিট’ জার্নাল লুই ভুটো সংস্থার প্রেসিডেন্ট এবং সিইও বার্নার্ড আর্নাল্টের এই অদ্ভুত পরীক্ষা পদ্ধতির কথা তুলে ধরেছে। পাঁচ পুত্র-কন্যার সঙ্গে মাসে একবারের বেশি দেখা করার সময় পান না বিশ্বের অন্যতম এই ধনী ব্যক্তি। ঐ দিনই মধ্যাহ্নভোজের টেবিলে মূলত দেখা হয় তাদের। প্যারিসে লুই ভুটোর সদর দপ্তরে পাঁচ পুত্র-কন্যার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে বসেন কর্তা। প্রায় ৯০ মিনিট ধরে বন্ধ ঘরে চলে সেই ভোজ। ভোজের শুরুতেই নিজের আইপ্যাড থেকে ফরাসি এ শিল্পপতি পড়ে শোনান, সেদিন কী নিয়ে চলবে আলোচনা। ঐ মধ্যাহ্নভোজের টেবিলেই আর্নাল্ট ‘অডিশন’ নেন পুত্র-কন্যাদের। কে হবেন তার উত্তরসূরি, তা বোঝার চেষ্টা করেন। প্রায় ১০ বছর ধরে এই পরীক্ষা পদ্ধতি চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে সন্তানদের প্রস্তুতও করছেন ৭৪ বয়সি আর্নাল্ট। তবে কাকে বাছাই করতে চলেছেন নিজের উত্তরসূরি, তা গোপনই রেখেছেন তিনি। একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের উত্তরসূরি নির্বাচনে এমন একটি কঠিন পরীক্ষাব্যবস্থা; একটি দেশের উত্তরসূরি তথ্য শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনে সেই পরীক্ষাব্যবস্থা ঠিক কেমন হতে পারে—এ দেশের জনগণ কি তা সত্যি সত্যি কখনো দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছে? অনেকেরই ধারণা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আয়োজনে যে নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অধিক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার প্রস্তুতি ও গ্রহণযোগ্যতা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় কোনো প্রশ্ন ওঠার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এই সরকারের অধীনে হওয়া ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে ছিল না সার্বিক প্রস্তুতি।
ইতোমধ্যে গত ১৭ জুলাই ২০২৩ ঢাকা-১৭ আসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচন সংঘটিত হয়ে গেল। এ নির্বাচনটি কেন এমন হলো, যেখানে এমপিকে তার নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি নৈতিক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো। তিনি জনপ্রতিনিধি, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্ব পেলেন না। হয়তো এটি উপনির্বাচন, মাত্র কয়েক মাসের এমপি—সেজন্য অনেকের আগ্রহ ছিল না। এমন সব যুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু পুরো ব্যবস্থার শেষ কথা হিসেবে চালিয়ে নেওয়া যায় না।
এ প্রসঙ্গে আরো একটি গবেষণার গল্প বলছি। আমেরিকার প্রথম সারির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগার। এক পাশে রাখা হলো একটি মই। মইয়ের ওপরে বেঁধে রাখা হলো এক কাঁদি কলা। পরীক্ষাগারে ছেড়ে দেওয়া হলো ১০টি বাঁদর। কলার লোভে সব বাঁদরই দৌড়ে গেল মইয়ের কাছে এবং মই বেয়ে উঠতে লাগল কলার কাছে। যখন তারা মইয়ের মাঝপথে, তখনই চারদিক থেকে হোজ পাইপের মাধ্যমে প্রবল গতিতে বরফ-ঠান্ডা পানি আছড়ে পড়ল বাঁদরদের শরীরে। প্রথমে তারা হতভম্ব। তারপর প্রাণপণে মই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা। কিন্তু পানির তোড়ে শেষ রক্ষা তাদের হলো না। ১০ বাঁদরই ছিটকে পড়ল এদিক-ওদিক। বাঁদর মাটিতে পড়ে যেতেই বন্ধ করে দেওয়া হলো জলকামান। খানিক ক্ষণ দেখে আবার মইয়ের দিকে রওনা দিল বাঁদরের দল। কিন্তু মাঝ মইয়ের পথে আবার সেই একই বিপত্তি। নাছোড় বাঁদররা কলা পেড়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেল আরো বেশ কয়েক বার। কিন্তু প্রতিবারই পড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা সইতে হলো তাদের। একসময় হাল ছেড়ে দিল তারা। দেখা গেল, জলকামান বন্ধ করে দেওয়ার বহুক্ষণ পরেও মইয়ের দিকে আর চট করে এগিয়ে গেল না কোনো বাঁদরই।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, দলের মধ্যে এক বাঁদর সাহস করে মইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেও তাকে টেনে-হিঁচড়ে থামিয়ে দিচ্ছে বাকিরা। ভয় বাসা বেঁধেছে বাঁদরদের মনে। তাই তারা কলা থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তই শ্রেয় মনে করল। এখানেই শেষ নয়। গবেষকগণ এরপর ঐ ১০ বাঁদরের মধ্যে একটিকে চুপিসারে ঘরের বাইরে বের করে দিয়ে তার বদলে নতুন একটি বাঁদরকে ঢুকিয়ে দিলেন। কলার কাঁদি ঝুলতে দেখেই নতুন বাঁদরটি দৌড় দিল মইয়ের দিকে। কিন্তু সিঁড়ির কাছে পৌঁছানোর আগেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি ৯ পোড়খাওয়া বাঁদর। এবার বিজ্ঞানীরা এক-এক করে বাকি ৯ বাঁদরকেই বদলে দিলেন। প্রতিবার নতুন বাঁদর ঘরে ঢোকার পরে পুরোনোদের একই প্রতিক্রিয়া। মইয়ের দিকে কেউ এগোলেই টেনে সরিয়ে আনা। একটা সময় এলো, যখন ঘরে ১০ বাঁদরই নতুন। প্রথমে যখন মইয়ে উঠতেই প্রতিবার পানি ছোড়া হচ্ছিল, তখন পরীক্ষাগারে ছিল না এদের কেউই। এরা এক এক করে পরে ঢুকে শুধু দেখেছে; মইয়ের দিকে উঠতে গেলেই রে রে করে তেড়ে এসে থামিয়ে দেয় পুরোনোরা। দেখা গেল, এর পরে ঘরে নতুন ঢোকা আর এক বাঁদর মইয়ের দিকে এগোতেই, একইভাবে রে রে করে তেড়ে গিয়ে থামিয়ে দিচ্ছে ঐ আগে থেকে ঘরে থাকা ‘নতুন’ বাঁদররাও। সত্যিকারের জলকামানের ঠান্ডা স্রোতের সামনে এরা একবারও কিন্তু পড়েনি। তার পরও একই ঘটনাই ঘটল। কষ্মিনকালেও ঠান্ডা পানির অত্যাচার সহ্য না করা ঐ বাঁদরগুলোর পুরোনোদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে—নিশ্চয়ই ঐ মইয়ে চড়তে গেলেই মারাত্মক কোনো অনর্থ ঘটবে। তাই ঠিক কী ঘটে তা না জেনেও তারা এমন সন্ত্রস্ত। গবেষণার এই গল্পের সঙ্গে কি বাংলাদেশের ভোটারদের আচরণে কোথাও কোনো মিল আছে? ভোটাররা কি ধরেই নিয়েছে তারা যা-ই করুক, যা-ই ভাবুক, ক্ষমতাবানদের ঐ এক কথা—‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’। সোনার হরিণ জনগণের হাতে নেই—জনগণ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছে? নাকি অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওসব নিয়ে না ভাবার সংস্কৃতিতে?
দেশে এখন পাল্লা দিয়ে চলছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু তাতে রাজনীতির চর্চা কতটুকু, তা নিয়ে ভাবছে না কোনো পক্ষই। একপক্ষ ব্যস্ত বিক্ষোভ-সমাবেশ নিয়ে, আর অন্য পক্ষ ব্যস্ত শান্তি সম্মেলন নিয়ে। পাশাপাশি মারমুখী কর্মিবাহিনী নিয়ে যে যার মতো প্রস্তুত। জনগণের জন্য রাস্তা বন্ধ, কাজে যাওয়া বন্ধ। একদল সমাবেশ পেছালে, অন্য দলও পিছিয়ে নেয় তাদের সমাবেশ। পালটাপালটি সমাবেশ নিয়ে জনগণের বাড়তে থাকে উৎকণ্ঠা। ২ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪টি সমাবেশের সংবাদে রাজনৈতিক মহলে উত্কণ্ঠার ছাপ না থাকলেও জনগণের মনে বেড়ে যায় ভীতির পরিমাণ। দুটি দল দেখতেই ভুলে গেছে, তাদের কর্মসূচি ও পালটা কর্মসূচির প্রভাবে সর্বস্তরের জনসাধারণের জীবনপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না। তাদের মারমুখী পালটাপালটি সমাবেশ এবং আক্রমণ-সংঘাত-ভাঙচুর জনগণের মনে আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছে কি না।
এসব দেখে সাধারণ মানুষের যেন অনুভূতিশূন্য হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাই তাদের কিছুই যায়-আসে না— কে কোথায় কোন সমাবেশ করছে, কে কোথায় কোন ভোটে দাঁড়াচ্ছে। তারা শুধু চিন্তায় থাকে, কীভাবে তারা নিরাপদে থাকবে। ব্যস, আর কোনো অনুভূতিই যেন নেই তাদের।
লেখক: কলামিস্ট