‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর, উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর’—মাইকেল মধুসূদন দত্তের এ ভাষায় বর্ষা প্রকাশ পায় প্রকৃতির এক অপরূপ শক্তিরূপে! বর্ষাকালের দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে। তবে দিনদিন সাধারণ মানুষের জীবনকে যেন অভিশপ্ত করে তুলছে বর্ষাকাল! বর্ষাকাল আসতে না আসতেই জলাবদ্ধতার খবর শোনা যায় ফিবছর—এ যেন ধরাবাঁধা নিয়মে পরিণত হয়েছে। জলাবদ্ধতায় জনজীবন অতিষ্ঠ হওয়ার জোগাড়! ঘর থেকে রাস্তায় বের হলেই জমে থাকা কোমর সমান পানিতে নাকানিচুবানি খেতে হয়—কী আজব বিষয়! এসব পানির সঙ্গে ভেসে আসা ময়লা, দুর্গন্ধ পরিবেশ তথা মানব শরীরের জন্য যে কতটা ক্ষতিকর, আজকের দিনে তা অজানা নয় কারো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এ নিয়ে আমাদের যেন কোনো ভাবান্তর নেই!
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। দেশে গড় বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে জুন থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে। এসময় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের বেশির ভাগ জায়গাতেই পানি জমে যায়। পানির এরকম জমে যাওয়াকে আমরা জলাবদ্ধতা বলে থাকি। পর্যাপ্ত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকলে এ জলবদ্ধতা থেকে সৃষ্টি হয় ‘দুর্ভোগ-দুর্বিপাক’। বলে রাখা দরকার, জমে থাকা পানি যদি ড্রেন বা এ জাতীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে নদীতে মিশে যেতে পারত, তাহলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না, হতো না জনভোগান্তি। রাজধানী ঢাকার মতো উন্নত একটি শহরেও প্রতি বছর বর্ষাকাল শুরু হওয়ার আগে থেকেই জলাবদ্ধতার কারণে জটলা লেগে থাকে—ভাবা যায়! এক তথ্যে জানা গেছে, ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই ঢাকা শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা তলিয়ে যায়। বিষয়টি অত্যন্ত পরিতাপের। একটি দেশের পুরাতন ও বড় শহরাঞ্চল কিংবা খোদ রাজধানী শহরের এভাবে পানির নিচে চলে যাওয়ার দৃশ্য নিতান্ত দুঃখজনক বটে। এই অবস্থায় শহরাঞ্চলের স্বাভাবিক চিত্র ফিরিয়ে আনতে, জনসাধারণের জীবনযাপন স্বাভাবিক করতে প্রয়োজন জলাবদ্ধতা দূরীকরণে কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থার অবতারণা এবং অবশ্যই তা হতে হবে দ্রুততার ভিত্তিতে।
সত্যি বলতে, জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের ‘অসচেতনতা’। নগরায়ণের তাগিদ থেকে নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে আমরা দিনদিন এমনভাবে সংকুচিত ও ধ্বংস বা নষ্ট করে ফেলছি, যা আমাদের জন্য বড় দুর্ভোগ ডেকে আনবে সামনের দিনগুলোতে। এক তথ্যে জানা গেছে, আগে ঢাকার চারটি নদী ও ৬৫টি খাল এই মহানগরীর জল নিষ্কাশনে বড় ভূমিকা রাখত। আজ সেসব খালের বেশির ভাগই নেই। যেগুলো আছে দখল-দূষণ কিংবা নাব্যসংকটে জর্জরিত— যেন দেখার কেউ নেই। এসব খাল-নদীর এমন অবস্থা হয়েছে যে, এগুলো ‘ভরাট’ বন্ধ না করলে গোটা রাজধানীর নিষ্কাশন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে সম্পূর্ণরূপে। সুতরাং এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদেরকে নগরীর হারিয়ে যাওয়া কিংবা বেদখল হয়ে পড়া খালগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ কর?তে হবে। নতুন করে আর যাতে খাল ভরাট না হয়, দখল-দূষণের শিকার না হয়—সেদিকে নজর রাখতে হবে। শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমের নিয়মিত তদারকিও অতি গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি বিষয়, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মানব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র খুবই করুণ। তাছাড়া কঠিন বর্জ্য উন্মুক্ত ড্রেনে ছুড়ে ফেলার একটি বাজে সংস্কৃতিও রপ্ত করেছি আমরা, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে করে ড্রেনেজব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে একটু একটু করে। এর কারণ এসব কঠিন বর্জ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—প্লাস্টিক, পলিথিন, ক্যান ইত্যাদি। এগুলো সহজে পঁচে না বিধায় ড্রেনে সুয়ারেজ প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, যা থেকে জলবদ্ধতার সৃষ্টি হয় দীর্ঘ সময়ের জন্য।
শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—লেকের পানির স্তরের উচ্চতা এবং বিপত্সীমা থেকে তার দূরত্ব। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত উপায় হলো, যখনই ধারণক্ষমতার শতকরা ৯৫ শতাংশ পূর্ণ হয়ে যাবে, তখনই সঙ্গে সঙ্গে পানি পাম্প করে অতিরিক্ত পানি সরিয়ে লেকের পানির উচ্চতা কমাতে হবে। সময়মতো পানি পাম্প করলে আর পানিস্তরের উচ্চতা শতকরা ৯৫ শতাংশের ওপরে উঠতে না দিলে ঢাকা শহরের মতো বড় শহরের জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, নিজেদের হাতে সাজানো পরিবেশটা সুন্দর রাখতে নিজেদেরকেই সচেতন হতে হবে সর্বাগ্রে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়