প্রস্তাবিত আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এতে পরোক্ষ করের পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর প্রভাবে সাধারণ মানুষের ওপরই চাপ বাড়বে। আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য যার করযোগ্য আয় নেই তাকেও এখন কর দিতে হবে। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়নি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো অনুযায়ী করের আওতা তথা কর রাজস্ব বাড়াতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর জন্য পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর ওপরই মনোযোগী হতে হবে। তিনি বলেন, আয় বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। এটা কমাতে পরোক্ষ কর না বাড়িয়ে আমাদের করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পরোক্ষ কর বা ভ্যাট ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরে ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। এছাড়া আগামী অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে আয়, মুনাফা ও মূলধনের ওপর কর ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬০ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা, আমদানি শুল্ক ৪৬ হাজার ১৫ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক ৬৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর হিসেবে ১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বে করোনা মহামারির প্রভাব শেষ না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির নানা সীমাবদ্ধতার ফলে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যারা কর্মসংস্থানে আছেন তাদের সবার আয়-উপার্জনও সুষম হারে বাড়ছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন আয়ের এবং আড়াই কোটি হতদরিদ্রকে প্রতিনিয়ত পণ্য ও সেবা ভোগের জন্য পরোক্ষ করের বোঝা বইতে হচ্ছে। এতে ব্যক্তির আয় সংকুচিত হয়ে আসছে এবং বৈষম্যও বাড়ছে। এ অবস্থায় তাদের ওপর বাড়তি ভ্যাটের চাপ অসহনীয় হয়ে উঠবে।
সরকারের পরোক্ষ করের ওপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণে প্রতিনিয়ত নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে বলে উঠে এসেছে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের ‘প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন ইন বাংলাদেশ: হোয়াই অ্যান্ড হাউ?’- শীর্ষক এক গবেষণায়। ‘প্রোমোটিং সিটিজেনস পার্টি সিপেশন ফর প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সেশন’ প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণায় বলা হয়েছে, পরোক্ষ কর সমাজের সচ্ছল অংশের তুলনায় নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ কেড়ে নিচ্ছে। কারণ যে মানুষের দৈনিক আয় ২০০ টাকা, তার ওপরও পণ্য কেনায় ভ্যাটের প্রভাব ১৫ শতাংশ। আবার যার আয় ২ থেকে ৫ হাজার টাকা, তারও ঐ একই হারে ভ্যাট প্রদান করতে হয়। অর্থাৎ, এই পরোক্ষ করের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দরিদ্রদের প্রতি প্রত্যাবর্তনশীল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারেকের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় বাজেটে ধনী ও দরিদ্রদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ ধনী শ্রেণিভুক্ত। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের অর্থায়নের উৎস হিসেবে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১,২০,৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৭.৮৩ শতাংশ। কিন্তু আয়কর দিয়েছেন টিআইএন ধারীদের মাত্র ৩৩ শতাংশ। অথচ মোট জনসংখ্যার ১৮.৭ শতাংশই অতি দরিদ্র। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের অর্থায়নের উৎস হিসেবে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫৪.৬ শতাংশ। অর্থাৎ, আয়কর প্রদান না করলেও দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও ভোক্তা হিসেবে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ মূসক, পণ্য আমদানিতে পরোক্ষ কর, সম্পূরক শুল্কসহ অন্যান্য ভ্যাট, চার্জ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কর প্রদান করে থাকেন। অর্থাৎ, জাতীয় বাজেটেও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় আরও বলা হয়, কর ব্যবস্থায় দাপ্তরিক জটিলতা, হয়রানি ও অদক্ষতার কারণে যারা প্রত্যক্ষ কর প্রদান করতে চান তারাও কর ব্যবস্থা সম্পর্কে ভীতি ও অসন্তোষ ধারণ করেন। এসবের ফলে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় কম হয়। এর প্রভাব সরাসরি জাতীয় বাজেটে প্রতিফলিত হয়।
এ প্রসঙ্গে ওয়েভ ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী ইত্তেফাককে বলেন, অনেকের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আবার বিভিন্ন সিস্টেমের কারণে ধনীরা কর রেয়াত পান। কিন্তু পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে সে উপায় নেই। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে যে ভ্যালুঅ্যাডেড ট্যাক্স থাকে তা সরকারের জন্য পাওয়া সহজ হয়। যাদের টিআইএন আছে তাদেরই এখন ২ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হবে, যদি তার করযোগ্য আয় না থাকে তারপরও। এটা তো বৈষম্য। তাই এনবিআরের কর আহরণ সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বৈষম্য হ্রাস করে কর ন্যায্যতা ও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, প্রত্যক্ষ করতো যার আছে সেই দেয়। কিন্তু পরোক্ষ কর সবাই দেয়। এটা সরাসরি প্রান্তিকের পকেট থেকে যায়। কিন্তু সে যা দিচ্ছে তাতো সরকারের পকেটে ঠিকমতো যাচ্ছে না। এটাই বড় কষ্টের জায়গা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজেট প্রস্তাবে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও এর সক্ষমতা বাড়াতে তেমন কিছু বলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘সক্ষমতা একদিনেও বাড়বে না’—এ কথা বলে বলে আমরা ৫২ বছর পার করেছি। এখন এনবিআরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।