ব্রুনাইয়ে এক বৎসর ধরিয়া পড়িয়া রহিয়াছে বরিশালের গৌরনদীর শিপন হালদারের (৪৪) লাশ। হৃদরোগে আক্রান্ত হইলে তিনি সেইখানকার রিপাচ হাসপাতালে ভর্তি হন। এনজিও ও স্থানীয়দের নিকট হইতে ঋণ করিয়া তিনি বিদেশ গিয়াছিলেন। তাহার চিকিৎসার জন্য আবারও ঋণ করিয়া পাঠানো হয় দেড় লক্ষ টাকা। হতদরিদ্র সেই পরিবারটির এখন ব্রুনাই হইতে স্বজনের লাশ আনিবার সামর্থ্যও নাই। তাহাদের চোখের পানি শুকাইয়া গিয়াছে; কিন্তু অপেক্ষার প্রহর শেষ হইতেছে না। অগত্যা তাহারা শিপনের মরদেহ শেষবারের মতো একনজর দেখিতে ও জন্মভূমিতে দাফন করিবার ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আকুল আবেদন জানাইয়াছেন।
ইত্তেফাকে প্রকাশিত এমন একটি মানবিক প্রতিবেদন পড়িয়া যে-কাহারো অশ্রু সংবরণ করিতে পারিবার কথা নহে। যেই প্রবাসী শ্রমিকদের আমরা রেমিট্যান্স-যোদ্ধা হিসাবে গর্ব করিয়া থাকি, সেই যোদ্ধারা প্রবাসজীবনে কেমন আছেন, তাহা একজন শ্রমিকের লাশ এক বৎসর ধরিয়া বিদেশি হাসপাতালে পড়িয়া থাকা হইতেই সম্যক উপলব্ধি করা যায়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এই দুঃখজনক ঘটনাটির দায়দায়িত্ব এড়াইতে পারে না কিছুতেই। সেইখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকেরা কেন এই ব্যাপারে দায়িত্বহীনতা ও অমনুষ্যত্বের পরিচয় প্রদান করিলেন, তাহাও একটি প্রশ্ন। যখন কোনো প্রবাসী শ্রমিক বিদেশে যান, তখন তিনি ২৫০ টাকা সার্ভিস চার্জের পাশাপাশি কল্যাণ বোর্ডে ৩ হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা দেন। কেহ বিদেশে মারা গেলে সেই কল্যাণ তহবিল হইতে লাশ পরিবহন ও দাফনের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড হইতে ৩৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। আবার বিনা মূল্যে সেই লাশটি বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষের পরিবহন করিয়া আনিবার কথা। তাহা হইলে একজন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দিনের পর দিন বিদেশে পড়িয়া থাকে কীভাবে? শুধু তাহাই নহে, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শ্রমিকদের লাশ গ্রহণেও হয়রানির শিকার হইতে হয়। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সেই ৩৫ হাজার টাকাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না।
উদ্বেগের বিষয় হইল, প্রবাসী শ্রমিকের লাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবার সংখ্যা দিনদিন বাড়িতেছে। সরকারি এক হিসাবমতে, গত এক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করিতে যাওয়া ২৭ হাজার ৬৬২ জন শ্রমিকের লাশ ফেরত আনা হইয়াছে দেশে। গড়ে প্রতিদিন ১০ জনেরও অধিক প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে ফিরিয়া আসিতেছে। অধিকাংশের মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হইতেছে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, আত্মহত্যা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, স্বাভাবিক মৃত্যু ইত্যাদি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, বাংলাদেশ হইতে বিদেশ যাওয়া অধিকাংশ শ্রমিকের বয়স ২০ হইতে ৩৫ বৎসরের মধ্যে। সাধারণত তাহাদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে মারা যাইবার কথা নহে; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তাহারা তাপমাত্রার সহিত খাপ খাওয়াইতে এবং এই জন্য স্বাস্থ্যসচেতনতার পরিচয় দিতে না পারায় তাহাদের অনেকে পানিশূন্যতা, কিডনি জটিলতাসহ নানা অসুখবিসুখে মারা যাইতেছেন। তাহাদের কেহ কেহ অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হইয়াও মারা যাইতেছেন। এই সকল মৃত্যু ও প্রবাসীদের স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন লইয়া নূতন করিয়া ভাবিবার সময় আসিয়াছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে ১৬৮টি দেশে ১ কোটি ২০ লক্ষেরও অধিক বাংলাদেশি কাজ করিতেছেন। তাহার পরও প্রতিদিন গড়ে ১০ জন প্রবাসী বাংলাদেশির লাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবার ঘটনাকে অনেকে একটি জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে বিবেচনা করিতেছেন। এই বিয়োগান্ত ঘটনাকে একটা মামুলি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিবার মানসিকতাও পরিত্যাগ করা উচিত। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটিলেই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় আইনগত জটিলতায় লাশ ফেরত আনিতে বিলম্ব হয়। এই জন্য ভারত ও পাকিস্তানের ন্যায় সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক দেশের দূতাবাসগুলিতে আমাদের আইন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া দরকার। ইহা ছাড়া যেই সকল দেশে আমাদের কূটনৈতিক মিশন ও শ্রমকল্যাণ উইং নাই, অথচ সেইখানে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক রহিয়াছেন, সেইখানে মিশন ও উইং প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ লওয়া অপরিহার্য।