ভারী বর্ষণ ও উজান হইতে নামিয়া আসা ঢলের কারণে দেশের বিভিন্ন নদনদীর পানি বৃদ্ধি পাইতেছে। বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়াছে অন্তত তিন বিভাগে। বর্তমানে দেশের পার্বত্য তিন জেলায় কমিয়া আসিয়াছে বন্যার পানি। ইহাতে সেইখানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হইয়াছে; কিন্তু বৃষ্টি ও ভারতের উজান হইতে নামিয়া আসা ঢলে উত্তরাঞ্চলের নদনদীগুলিতে এখন পানি বাড়িয়াই চলিয়াছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানাইয়াছে, ভারী বৃষ্টি এখন দক্ষিণ হইতে সরিয়া আসিয়াছে উত্তরের দিকে। ইহাতে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডালিয়া ও রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার উপর দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। গতকালের অনলাইনের খবর অনুযায়ী তিস্তার পানি বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটারের উপর দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। পানি বাড়িয়া যাইবার কারণে খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট। তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা—নদনদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাইতেছে। কুশিয়ারা ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সকল প্রধান নদীর পানি বাড়িতেছে ক্রমাগতভাবে।
উল্লেখ্য, এই বছর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে সুনামগঞ্জ জেলায় দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা। তবে ইহা চার-পাঁচ দিনের অধিক স্থায়ী হয় নাই। গত বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জে সৃষ্ট বন্যায় আর্থিক ও অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঐ বন্যা স্বল্পমেয়াদী হিসাবে শুরু হইলেও পরে পানি নামিয়া যাইতে বিলম্ব হওয়ায় তাহা দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় রূপ নেয়। প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হইয়া পড়ে। তাই সাবধানের মাইর নাই। এইবারও আমাদের সকল প্রকার পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করিতে হইবে। কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, গত শুক্রবার হইতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, সিকিম ও বাংলাদেশের রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলিতে একাধিক নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি উচ্চতা দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। গত রবিবার বন্যার পানি যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া গিয়াছে। ২০ আগস্টের পর বৃষ্টিপাত আরও বৃদ্ধি পাইতে পারে। ইহাতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হইতে পারে। এই জন্য এখন হইতেই সতর্কতা অবলম্বন করিতে হইবে। পানিবন্দি মানুষকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতায় আগাইয়া আসিতে হইবে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সূত্র মতে, গত বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জে যে বন্যা হইয়াছিল তাহা ছিল প্রচণ্ড বন্যা। সেই আশঙ্কা এবার উড়াইয়া দেওয়া যায় না। বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষাকালে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং উত্তরাঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট ও যমুনা তীরবর্তী গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া—এই সকল জেলা শুরুতেই বন্যার ঝুঁকিতে পড়ে। আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বরাক এলাকার পানি নামিয়া আসিবার কারণেই অধিকাংশ বন্যা হয়। গত বছর তিন হইতে চার দিনে প্রায় ২ হাজার ৫০০ হইতে ২ হাজার ৬০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হইয়াছিল ভারতের চেরাপুঞ্জিতে। সেই পানি ভাটির দিকে নামিয়া আসিবার কারণে দেখা দিয়াছিল দীর্ঘমেয়াদি বন্যা।
মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা দিতেছে বন্যা পরিস্থিতি। কিছুদিন পূর্বেও চীনের অবস্থা ছিল বিপজ্জনক। আমরা বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক উন্নতি করিয়াছি। তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস যেন আমাদের ক্ষতির কারণ না হয়। পূর্ব হইতেই প্রস্তুতি থাকিলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কাটাইয়া উঠা সম্ভব। ইহা ছাড়া আমরা অধিকাংশ সময় বন্যা চলাকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা তথা উদ্ধার তৎপরতা, ত্রাণ বিতরণ ইত্যাদির প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করি। তবে বন্যার পানি নামিয়া যাওয়ার পর জনস্বাস্থ্য রক্ষা, বন্যাকবলিত মানুষের পুনর্বাসনের প্রতি আমাদের অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাহা ছাড়া আমাদের নদনদীগুলি যেইভাবে দখল, দূষণের শিকার হইতেছে ও ভরাট হইয়া যাইতেছে, ইহাতে নদীগুলির পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পাইতেছে। এই ব্যাপারে যেমন ড্রেজিং কার্যক্রম বৃদ্ধি করিতে হইবে, তেমনি নদী রক্ষায় সচেতনতার পরিচয় দিতে হইবে।