বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ও আমাদের করণীয়


একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সে দেশের মোট আয়। কেননা, আয়ের ওপরেই নির্ভর করে দেশটির ব্যয়, উত্পাদন এবং সঞ্চয়। একটি দেশের মোট আয় বৃদ্ধি পাওয়া মানে হচ্ছে সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বোঝায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলে আয় যে বাড়ে সেটা গরিব, ধনী উভয়েরই বাড়ছে কি না? অথবা ধনী-গরিবের আয় বাড়ার অনুপাতটা সমান কি না? মূলত এই যে একক আয় সমানভাবে বৃদ্ধি না পাওয়া বা আয় বৃদ্ধির অনুপাতের তারতম্য হওয়াকেই সাধারণত আয়বৈষম্য বলা হয়।

সাধারণত দুটি উত্স থেকে আমরা আয় করে থাকি। প্রথমটি হলো শ্রমলব্ধ আয়, যা আসে মজুরি, বেতন, বোনাস ইত্যাদি থেকে। আর দ্বিতীয়টি হলো পুঁজিলব্ধ আয় বা মূলধনলব্ধ আয় যা আসে খাজনা, বাড়িভাড়া, সুদ, মুনাফা, মূলধনের মূল্যবৃদ্ধি, রয়ালটি, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি, স্থাবর সম্পত্তি, আর্থিক সম্পদ, কারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি থেকে। যদি কোনো দেশের মূলধনলব্ধ বা পুঁজিলব্ধ আয়ের প্রবৃদ্ধির হার দেশের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আয়বৈষম্য বাড়বে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য থাকবেই। তবে তা সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব রাষ্ট্রীয় পলিসির মাধ্যমে। একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একটি বৈষম্যহীন সুষম অর্থনৈতিক সমাজকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। কেননা, একটি বৈষম্যহীন সুষম অর্থনৈতিক সমাজকাঠামো প্রতিষ্ঠা ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আয়বৈষম্য কমিয়ে এনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথ তৈরি করে। এ জন্য প্রত্যেক জাতির জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সব ধরনের অসমতা হ্রাস করা অত্যন্ত জরুরি।

একটি দেশের আয়ের বৈষম্য পরিমাপ করার একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে গিনি সহগ (Gini Coefficient) বা গিনি সূচক (Gini Index)। ১৯১২ সালে ইতালির সংখ্যাতত্ত্ববিদ কোরাদো গিনি এর উদ্ভাবক এবং তার নাম অনুসারে এটা গিনি সহগ বা গিনি সূচক নামে পরিচিতি লাভ করে। গিনি সহগ বা গিনি সূচক একটি অনুপাত, যার মান ০ থেকে ১-এর মধ্যে হবে। সবার আয় সমান হলে গিনি সূচকের মান হবে ০ (শূন্য), যার অর্থ হচ্ছে চরম সাম্য অবস্থা বিরাজ করছে, অর্থাত্ অর্থনীতিতে সব সম্পদের বণ্টনে সম্পূর্ণ সমতা রয়েছে।

বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক খানা আয় ও ব্যয় জরিপ করা হয়। ১৯৭৩ সালের জরিপের ফল অনুযায়ী বাংলাদেশের গিনি সহগের মান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩৬ এবং দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ ঐ সময়ে দেশের মোট আয়ের ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ আয় করত। গত দেড় যুগে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাংলাদেশের আয়বৈষম্য। ২০১৬ সালে বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের ফল অনুযায়ী গিনি সহগ বেড়ে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৮৩ এবং দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা ছিল মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ।

গবেষকেরা মনে করেন, গিনি সহগের মান বৃদ্ধি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কেননা, সর্বশেষ বিবিএস কর্তৃক প্রচারিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (HIES)-২০২২  মোতাবেক আয়বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগ বাংলাদেশে শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে এবং দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা বেড়ে হয়েছে মোট আয়ের ৪০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এমনকি দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় এখন দেশের মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ। অর্থাত্, দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ আয় যাচ্ছে দেশের ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে এবং বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের অবশিষ্ট ১ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ এখন উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। কেননা, গিনি সহগের মান শূন্য ৫০ পয়েন্ট পেরোলেই একটি দেশকে উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেখানে বাংলাদেশে গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯৯।  গবেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের আয়বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য হ্রাসে এখনো সাফল্য অর্জিত হয়নি।

তবে আশার কথা হচ্ছে, দেশে ভোগ গিনি সহগের মান আয় গিনির চেয়ে অনেক কম। ভোগ সহগ বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগ বাংলাদেশে শূন্য দশমিক ৩৩৪-এ পৌঁছে গেছে, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪ এবং ২০১০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২১। অর্থনীতিবিদের মতে, বাংলাদেশের আয়বৈষম্য রোধকল্পে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিদ্যুত্, সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কেননা, মানুষের আয় ও মজুরি বাড়লে বৈষম্য কমে আসবে।

বাংলাদেশে আয়বৈষম্য হ্রাস ও অসমতা দূরীকরণে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে : 

১. মানবসম্পদ উন্নয়ন :বৈষম্য রোধের জন্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। কেননা, এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য নতুন ও শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, আয়বণ্টন উন্নত হবে, সর্বোপরি বৃদ্ধি পাবে প্রবৃদ্ধির হার। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে যথাক্রমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে।

২. গ্রামীণ অবকাঠামো ও কৃষি উন্নয়ন :গ্রামীণ অবকাঠামো ও কৃষি উন্নয়নে, বিশেষ করে গ্রামের রাস্তাঘাট, বিদ্যুত্, সেচব্যবস্থা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং পানির লবণাক্ততা নিরোধ প্রকল্পে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। উচ্চফলনশীল জাতের ফসলের চাষাবাদ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন সহনীয় বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের উত্পাদন বাড়াতে হবে। কেননা, এর মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে, শ্রমিকদের গড় উত্পাদনশীলতা ও গ্রামীণ মজুরি বাড়বে এবং গ্রামীণ মানুষের নগরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের প্রবণতা হ্রাস পাবে।

৩. ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ঋণ (এসএমই) :স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়তা করে। এছাড়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ঋণ (এসএমই) গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মূলধনের সংকট সমাধানে সহায়তার পাশাপাশি স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

৪. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি ও সংস্কার : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে। বাংলাদেশে বৈষম্য কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ব্যাপক বাড়ানো দরকার এবং অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও জোরদার করা জরুরি। শহরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচি ও অভিনব কায়দায় জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

৫. শ্রমিকের দক্ষতার মানোন্নয়ন :দেশের শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নে প্রোগ্রাম নিতে হবে এবং বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে। আবার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে উত্পাদনশীল শ্রমশক্তির সঙ্গে সংযোগ ঘটবে, যার মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব হবে।

৬. প্রগতিশীল করারোপ পদ্ধতি :আয়বৈষম্য রোধের অন্যতম উপায় হচ্ছে প্রগতিশীল (প্রগ্রেসিভ) করারোপ পদ্ধতি, যার মূল সুবিধাভোগী হবে দরিদ্র শ্রেণি-পেশার প্রান্তিক মানুষ। প্রগতিশীল (প্রগ্রেসিভ) করারোপ পদ্ধতি বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়বৈষম্য মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় বাড়িয়ে সরকার বিভিন্ন অগ্রাধিকার খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সক্ষম হবে।

৭. সুশাসন ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান :অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি ও সরকারি সম্পদ ব্যবহারে দুর্নীতি ও সরকারি ভূমি দখলদারিত্ব মোকাবিলায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেননা, সুশাসন ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান আয়বণ্টন সুষম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৮. গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আনয়ন :গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আনয়নের জন্য সরকারের  বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশের আয়বৈষম্য হ্রাসে উপরোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি জরুরি হচ্ছে বৈষম্য কমাতে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। আয়বৈষম্য বিলোপ সম্ভব হলেই কেবল মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল প্রান্তিক জনগণের কাছে পৌঁছাবে। তাহলেই নিশ্চিত হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন।

লেখক: উপসচিব ও কনসালট্যান্ট, এটুআই প্রোগ্রাম





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/652969/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A7%9F%E0%A6%AC%E0%A7%88%E0%A6%B7%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%93-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%80%E0%A7%9F

Sponsors

spot_img

Latest

Flashback: Tucker Carlson Hammered Jon Stewart So Hard it Ended His CNN Gig

The tragedy of Tucker Carlson’s firing from Fox News had me thinking… of when he was fired by CNN. The hilarious incident came...

Helium’s Solana Migration Fuels Cutting-Edge IoT Applications

Since Helium migrated to Solana, the network has expanded its IoT applications.  Helium protocol now powers...

Announcing My Exclusive, Limited-Time Collection of Tabletop Linens! | Wit & Delight

Shop the Wit & Delight x Willow Ship line of tabletop linens available for a limited time only at Etsy.  We’ve got exciting news...

How to Reskill Your Workforce in the Age of AI

By now, it’s probably clear to most of us that the Age of AI has arrived. Artificial intelligence applications promise to transform nearly...

A new metric in ad tech: Carbon emissions

Check out all the on-demand sessions from the Intelligent Security Summit here. The digital advertising industry is beginning to wake up and respond to...